যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো,
চলে এসো, এক বরষায়
আমি যখন এই লেখা লিখছি তখন চারিদিকে ঝুম বৃষ্টি।ঝুম বৃষ্টি কথাটা বোধহয় শহরের সাথে পুরোপুরি মানায় না। চারিদিকে ঘন জঙ্গল, মাঝখানে একটি দোচালা টিনের ঘর, সেখানে আছড়ে পরছে বর্ষার জলধারা, কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশের অশ্রুধারা বর্ষনের মাত্রার উপর নির্ভর করে ক্রমেই পাল্টাচ্ছে ছন্দ, কখনো দাদরা বা কখনো কাহারবা।
যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি
বর্ষা ঋতু এবং কদমফুল দুটোই ওনার খুব প্রিয়। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে যাওয়ার কথা আমি কার কথা বলছি। হ্যাঁ উপরের গান বা কবিতার পঙক্তিগুলো যার উনি আর কেউ নন আমাদের অত্যন্ত প্রিয় প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
প্রয়াত শব্দটা লেখার সময় হঠাৎ হাতটা কেমন কেঁপে উঠলো, এবং মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। কারণ আমার কাছে উনি ছিলেন বিশেষ কেউ। আমি উনার কাছে অনেকাংশেই ঋণী। উনি আমাকে বই পড়তে শিখিয়েছেন। শুধু আমাকে নয় উনি অনেক তরুণ পাঠক তৈরি করেছেন উনার লেখার সম্মোহনী শক্তি দিয়ে। আজকে হুমায়ূন আহমেদ না পড়লে হয়তো আমার রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, নজরুল, শরৎচন্দ্র কোনটাই পড়া হতো না।
গতকাল রাতে হঠাৎ মনে পড়ল একদিন পরে আমার এই প্রিয় লেখক এর মৃত্যুবার্ষিকী। চাকরি এবং জীবনের ব্যস্ততায় অনেকদিন বই পড়া হয়না, তাই মাঝ রাতে উঠে গেলাম আমার বুকশেলফের কাছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে নয় এক অজানা কারণে ঘুম আসছিল না। চঞ্চল চোখ স্থির হল হিমু সমগ্র বই টার দিকে। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের বেশকিছু শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে হিমু এবং মিসির আলি অন্যতম।
পাশের বইগুলোকে আটকে ধরে বের করলাম হিমু সমগ্র বইটা। একসময় যে বইছিল দিনের দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী সেই বই এ এখন তেলাপোকা বাসা করেছে। মাঝরাতে একটি জীব হত্যা করতে আর ইচ্ছে করলোনা, তাই বিনা বাধায় বয়স্ক তেলাপোকাটাকে যেতে দিলাম তার বাকি আত্মীয় পরিজনের কাছে। তেলাপোকাদেরও হয়তো ঘর সংসার আছে, ছেলেপুলে নাতি-নাতনি অথবা একটি ঝগড়াটে শাশুড়ি আছে। তারা নিশ্চয়ই কারো মৃত্যুতে কাঁদে, যেমনটা হাজারো মানুষ কেঁদেছিল এই ক্ষণজন্মা সাহিত্যিকের মৃত্যুতে।
এই জীবনে প্রত্যেকবার হিমু পড়ার সময় নিজেকে তার চরিত্রে দাঁড় করিয়ে পুরো উপন্যাসটা শেষ করেছি। যদিও কাল্পনিক এবং অনেকটাই বাস্তব বিবর্জিত তারপরও হিমু হতে ইচ্ছা করে। আমার ধারণা শুধু আমার নয় অনেকেরই হিমু হতে ইচ্ছা করে। হিমুর সরলতা, উদাসীনতা ক্ষেত্রবিশেষে অলৌকিক ক্ষমতা, সবকিছুই তরুণ প্রজন্মের মনের মধ্যে পুষে থাকা গোপন ইচ্ছা, যাকে হুমায়ূন আহমেদ কলমের মাধ্যমে চরিত্রের আকার দিয়েছেন।
হিমুর ঠিক বিপরীত চরিত্র মিসির আলি যার কাছে লজিক ছাড়া কোনো কিছুরই স্থান নেই, যিনি বিশ্বাস করেন পৃথিবীতে সব কিছু হয় লজিক এবং সায়েন্সের সমন্বয়ে। তবে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখায় বিভিন্ন সময়ে হিমু এবং মিসির আলিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল কোন উপন্যাসের উপসংহারে এই দুটি চরিত্রকে একচ্ছত্রভাবে বিজয়ী করেননি। তাই আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সাইন্স এর একজন বড় মাপের শিক্ষক হওয়া সত্বেও তার মনের ভেতর সায়েন্স এবং অদৃশ্য শক্তি দুটোতেই কমবেশি বিশ্বাস ছিল।
পরিশেষে উদার পাঠকদের মনে হুমায়ূন আহমেদ যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন। এখানে উদার কথাটা এই জন্য ব্যবহার করলাম কারন এক শ্রেণীর স্বঘোষিত পন্ডিত পাঠক রয়েছেন যারা হুমায়ূন আহমেদের লেখা কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাথে তুলনা করেন। এই শ্রেণীর পাঠক হয়তো তার লেখা না পড়েই এই রকম মন্তব্য করে, কারণ হুমায়ূন আহমেদ প্রায় প্রতিটি লেখায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের উক্তি ব্যবহার করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের হিমু পড়ে আমি হেসেছি, মিসির আলি পড়ে লজিক শিখেছি, দারুচিনিদ্বীপ পড়ে বন্ধুত্ব শিখেছি, রুপাকে দেখে প্রেমে পড়েছি, কোথাও কেউ নেই নাটক দেখে কেঁদেছি। তাই তার কাছে আমি চিরঋণী। হয়তো কোন এক বর্ষায়, একগুচ্ছ কদম হাতে তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলব- কবি আমি এসেছি আপনার ডাকে, আপনার ঋণ শোধ করতে। আর মনে মনে গুনগুন করে সুর তুলবো তার লেখা সেই গান...
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো,
চলে এসো, এক বরষায়