মাতৃভূমি থেকে হাজার মাইল দূরে গিয়ে পরিবারের স্বার্থে উপার্জন করা ব্যক্তিটা প্রবাসী। নিজে কষ্টে থেকে পরিবারের কাছে ভালো আছি বলা ব্যক্তিটা প্রবাসী।
সন্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার জন্য বছরের পর বছর বিদেশে পরে থাকে এই মানুষগুলো। তীব্র রোদে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, খেয়ে না খেয়ে দিনের পর দিন তারা পার করে দেয় পরিবারের মানুষগুলোকে একটু ভালো রাখবে বলে। নির্ধারিত সময়ের বাইরেও তারা অতিরিক্ত সময় কাজ করে একটু বাড়তি উপার্জন হবে বলে।
পরিবারের স্বার্থে এই মানুষগুলো নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। প্রবাস থেকে কখনো তারা ফিরে নিজের জীবন যৌবন শেষ করে, আবার কখনো বা ফিরে কফিনবন্দি হয়ে প্রানহীন দেহটাকে নিয়ে। এতোকিছুর পরেও কি তারা তাদের যথার্থ সম্মানটুকু পায়? ‘ না ’।
অনেকে তো আবার প্রবাসীদের মানুষ বলেই গন্য করে না। অনেকের কাছে আবার তারা টাকার মেশিন। যতদিন মেশিনটার কাছ থেকে টাকা পাওয়া যাবে ততোদিন তার মূল্য আছে, টকা নাই তো মূল্য ও নাই ৷ কাছের মানুষগুলো, যাদের জন্য এত কিছু, তারাই তো আর আপন থাকে না। পরিবারের কাছে তখন সেই মানুষটি একটা বোঝা মাত্র।
আজকে আমি এমন এক প্রবাসীর সম্পর্কে কথা বলবো যার কষ্টের কথাগুলো আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করেছিল সেদিন ।
অভাগা মানুষটির নাম শাহজাহান। সম্পর্কে আমার আত্মীয় হন তিনি। ছোটবেলাই বাবা হারা হন তিনি। পরিবারের উপার্জনক্ষম কোন ব্যক্তি ছিলো না।
পরিবারের ভরণ-পোষনের দায়িত্ব এসে পড়ে মায়ের উপর। অন্যের বাসায় কাজ করে, গরু লালন পালন করে, তার আয় দিয়েই ছেলে-মেয়েকে বড় করে তোলেন। কষ্টে সংসার চলছিল কোনভাবে। মা ও এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তিন ভাই এক বোনের সংসার এখন আর চলছিলো না।
পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে নিজেদের শেষ সম্বল এক বিঘা জমি বিক্রি করে শাহজাহান পাড়ি জমায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে। তার কাজ ছিল খেজুর বাগান পরিচর্যা করা। বেতন ছিল খুবই অল্প পরিমাণ। পরিবারে কিছু বাড়তি টাকা পাঠানোর জন্য সে প্রতিদিন ১৪ ঘন্টা কাজ করতো। কিছুদিন পরেই তাদের পরিবারে কিছুটা সচ্চলতা ফিরে আসলে বোনের বিয়ে দিয়ে দেয়। নিজে পড়াশোনা করতে পারেনি টাকার অভাবে, কিন্তু তার ইচ্ছে ছিল তার ভাইয়েরা উচ্চশিক্ষিত হবে ৷ যা আয় করতো সে তার সবটুকুই পরিবারের জন্য পাঠিয়ে দিত।
প্রায় দশ বছর পরে দেশে ছুটিতে আসে সে। একটা ভালো পরিবার দেখে বিয়েও করে ফেলে ৷ কিছুদিন পর আবার ফিরে যায় প্রবাসে। ভালোই চলছিল দিনগুলো। হঠাৎ করেই করোনা পরিস্থিতি সব ওলট-পালট করে দেয়। কাজের অভাবে দেশে ফিরে আসতে হয় তাকে।
দেশে আসার কিছুদিন পরেই হার্ট অ্যাটাক করে অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজের শেষ সম্বলটুকু শেষ হয়ে যায়। শারীরিক ভাবেও দুর্বল হয়ে পড়ে সে। পরিবারের মানুষগুলো এখন আর তাকে ভালোভাবে দেখে না। কিছুদিন আগেও যে মানুষগুলো ছিল সবচাইতে আপন এখন তারাই সবচাইতে পর হয়ে গেছে।
যেই ভাইদেরকে নিজের সমস্ত আয় দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছে, সেই ভাইয়েরাই নাকি এখন তার পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। একসময় আত্মীয়স্বজনদের চোখের মণি ছিল সে, তারাও নাকি এখন আর চিনে না। দু'মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে, অটোরিকশা চালায় এখন সে। শত অবহেলার পরেও জীবনযুদ্ধে হার মানেনি সে।
নিঃস্বার্থহীন ভাবে জীবন বিলিয়ে দিয়েও অকৃতজ্ঞতা মানুষকে মনের দিক দিয়ে মেরে ফেলে। স্বার্থহীন এই মানুষগুলো একটি সম্মানের ও সুন্দর জীবনের অধিকার রাখে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষটি হলো প্রবাসী।