প্রথম পর্বে আমি কিশোরগঞ্জ ভ্রমণ কাহিনী তুলে ধরেছিলাম, আজকের পর্বে থাকছে সিলেট ভ্রমণ কাহিনী।
প্রথম পর্বের লিংক : @fa-him/hkkns
দ্বিতীয় পর্ব :
৭ তারিখ (তৃতীয় দিন) ঃ ( আজকের পরিকল্পনা জাফলং, তামাবিল স্থলবন্দর, মায়াবী ঝর্ণা এবং লালাখাল ভ্রমণ )
খুব সকালে আমাদের বাস পৌঁছে যায় । তৃতীয় দিন সকালে সিলেট পৌছানোর পর আমাদের প্রথম কাজ ছিল হোটেল ঠিক করা৷ আমরা একটা মোটামুটি মানের হোটেল ঠিক করলাম ২ রাত ৩ দিন থাকবো বলে। হোটেলের অবস্থান ছিল সিলেট শহরের ভিতরে। হোটেলে ওঠার পর আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আমরা একমত হলাম প্রথম দিন আমরা ঘুরবো জাফলং, তামাবিল স্থলবন্দন, মায়াবি ঝরনা এবং বাংলার নীলনদ নামে পরিচিত লালাখাল। শেই অনুযায়ী আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে আগে সকালের নাস্ততা প্রথমে সেরে নিলাম।
আমরা সারাদিনের জন্য একটা লেগুনা ভাড়া করে সকাল ৮ টার দিকে রওনা দিলাম জাফলং এর উদ্দেশ্যে। ২ ঘন্টা পর আমরা পৌছালাম জাফলং জিরো পয়েন্ট এ। আমরা একটা নৌকা ভাড়া করলাম জাফলং ঘুরার জন্য। জাফলংয়ে আমরা মায়াবি ঝরনায় কিছুক্ষন গোসল শেষে নেমে পরলাম পিয়াইন নদীতে পুনরায় গোসল করার জন্য।
পাথরের দেশ জাফলং এর অপরূপ সৌন্দর্য আমাদেরকে মুগ্ধ করে তোলে । নীল রংয়ের স্বচ্ছ পানির প্রতি আমাদের ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায় । আমরা সব বন্ধুরা মিলে সময়টাকে উপভুগ করতে লাগলাম। অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও আমার কেন জানি উঠে জেতে মন চাইছিল না৷ নিজেদের ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে উঠে পড়লাম সবাই ৷ তারপর জাফলং এর একটি হোটেলে দুপুরের খাবারটা সেরে রওনা দিলাম তামাবিল স্থলবন্দর এর উদ্দেশ্যে।
তামাবিল স্থলবন্দর বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে অবস্থিত একটি বাণিজ্যিক বন্দর। তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে পাথর আমদানি করে থাকে ভারত থেকে। তামাবিল স্থলবন্দরে কিছুক্ষন সময় কাটানোর পর আমরা রওনা দিলাম লালাখাল এর উদ্দেশ্যে। প্রায় ১ ঘন্টা পর আমরা লালখাল ঘাটে পৌছালাম এবং একটা নৌকা ভাড়া করে বিকেলটা সেখানেই উপভোগ করলাম। লালাখাল কে বাংলাদেশের নীলনদ ও বলা হয়ে থাকে।
সন্ধ্যা ৭ টার দিকে আমরা আবার রওনা দিলাম সিলেট শহরের দিকে। ৮ টায় আমরা পৌছে যাই আমাদের হোটেল রুমে। হোটেলে সবাই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পরি রাতের খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমরা সিলেটের বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট পাঁচ -ভাই থেকে আমাদের রাতের খাবার শেষ করে পূনরায় হোটেলে ফিরে আসি। সারাদিনের ক্লান্তি এবং পরদিনের কথা ভেবে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আমরা রাত ১১ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পরি।
৮ তারিখ ( চতুর্থ দিন) ঃ ( আজকের পরিকল্পনা ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এবং রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট ভ্রমন )
পরিকল্পনা মতো আমরা সবাই সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে ওঠে পরি । আমাদের জন্য অনেক কষ্টের ছিল এতো সকালে ঘুম থেকে ওঠা। ঘুম থেকে ওঠে আমরা সবাই ৩০ মিনিট এর মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেলাম বের হওয়ার জন্য। আমাদের আজকের ঘুরার যায়গাগুলো হলো ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এবং রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট।
আমাদের ভাড়া করা লেগুনা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে হোটেল এর সামনে। আমরা সবাই সকাল ৭ টা ৪৫ মিনিট এ হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম, হোটেল "পানসিতে" নাস্তা করার জন্য । নাস্তা শেষে আমরা রওনা হলাম ভোলাগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে। সিলেট শহর থেকে ভোলাগঞ্জ এর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। আমরা সকাল ১০ টায় গিয়ে পৌছালাম ভোলাগঞ্জ। ভোলাগঞ্জ থেকে আমরা ট্রলারে করে পৌছালাম সাদা-পাথর এ।
চারদিকের অপরূপ সুন্দর্য আমাকে বিমোহিত করতে লাগলো। আকাশ সমান পাহাড় আর পাহাড়ের বুক ফেটে বয়ে চলছে ঝরনা। মেঘগুলো যেন পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ঊরে যাচ্ছে। পাথর -গুলো জেন একে অপরের সাথে ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আছে। ভারতের মেঘলয় রাজ্যের অপরূপ দৃশ্য আমার মন কেরে নিলো। মেঘালয় থেকে ঝরনার পানি পাথরের বুকের উপর দিয়ে বয়ে বয়ে আসছে বাংলার দিকে। স্রোত বয়ে চলছে বাংলার বুকে। আমাদের তর সইতেছিলো না কখন এই পানিতে গোসল করবো। তাড়াহুড়ো করে জিনিসপত্র গুলো একটা লকারে রেখে নেমে পরলাম স্রোতের বুকে।
আমরা সবাই একটি করে টিউব ভারা করে নিয়েছিলাম স্রোতে ভাসার জন্য। স্রোতের পানি-গুলো ছিল যেমন পরিষ্কার তেমনি থান্ডা। পানির নিচের পাথর গুলাও দেখা যাচ্ছিল। প্রায় ২ ঘন্টা গোসল করার পর আমরা ওঠে পরি। ড্রেস পরিবর্তন করে আমরা বেলা ১ টার দিকে রওনা হই রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট জাওয়ার উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে গাড়ি থামিয়ে আমরা আমাদের দুপুরের খাওয়া সেরে নেই। খাওয়া শেষে আমরা পুনরায় রওনা হই রাতারগুল এর উদ্দেশ্যে। বিকাল ৪ তার দিকে আমরা রাতারগুল পৌছে যাই। সেখানে আমরা একটি নৌকা ভাড়া করি রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট ঘুরার জন্য।
আমাদের নৌকা চলতে থাকে হাজারো গাছ -গাছালির মধ্যে দিয়ে৷ । গাছগুলোর মধ্যে বানর দেখা যাচ্ছিল, যারা এক গাছের ডাল থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে বেরাচ্ছিল। বনের মাঝ-খানে জেতেই শুনা গেল পাখিদের কিচি-মিচি শব্দ যা মন কেড়ে নিচ্ছল সাথে আমাদের মাঝির কণ্ঠে গান, কতই না সুন্দর সময় কাটছিল আমাদের।
কিছুক্ষন পর হঠাৎ বৃষ্টি নেমে গেল। সবাই বৃষ্টিতে ভিজে উপভোগ করলাম সময়টাকে। সন্ধ্যা ছয়টায় আমরা পুনরায় ফিরে আসলাম। রাতারগুলে হালকা নাস্তা সেরে আমরা পুনরায় গাড়িতে উঠে গেলাম শহরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রাত আটটায় হোটেলে পৌঁছে গেলাম। তারপর সবাই ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবারের জন্য বের হলাম। "পাঁচ ভাই" রেস্টুরেন্টে আমরা রাতের খাবার শেষ করে পুনরায় হোটেলে ফিরে আসি ।
এই দিনটাই ছিল আমাদের সবচাইতে আনন্দের দিন, যা কখনো ভুলার মত নয়। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রাত বারোটার দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে বলে।
৯ তারিখ (শেষ দিন ) ঃ ( আজকের পরিকল্পনা বিছানাকান্দি ভ্রমণ )
পরিকল্পনা মতো আজকে সকাল সাতটায় ঘুম থেকে ওঠার কথা থাকলেও, ১ ঘন্টা দেরি হয়ে যায় আমাদের । আমরা সবাই সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে পরি। ঘুম থেকে উঠে আধাঘন্টার মধ্যে সবাই তৈরি হয়ে নেই। আমাদের গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল। আমাদের আজকের প্ল্যান বিছনাকান্দি ঘুরা এবং পরিবারের জন্য কিছু কেনাকাটা করা। আমরা হোটেল পানসিতে সকালের নাস্তা সেরে নেই। সকাল 9 টায় আমরা বিছনাকান্দির উদ্দেশ্যে রওনা দেই।
বিছনাকান্দি সিলেট শহর থেকে প্রায় 50 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রথমে আমরা লেগুনায় করে যাই, পরে আমরা একটি ট্রলার ভাড়া করি বিছনাকান্দি যাওয়ার জন্য। বিছানাকান্দি ভারতের একেবারে পাশে অবস্থিত। বেলা 12 টার দিকে আমরা বিছানাকান্দি পৌঁছে যাই।
তারপর আমরা সবাই স্রোত-ময় পানিতে নেমে পড়ি আর উপভোগ করতে থাকি অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতিকে। এই সৌন্দর্য তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। কিছুক্ষণ পর আমরা বন্ধুরা মিলে কিছু পাথর কুড়িয়ে নেই স্মৃতিময় করে রাখার জন্য। বেলা দুইটার দিকে আমরা উঠে পড়ি এবং দুপুরের খাবার শেরে নেই। তারপর আমরা পরিবারের জন্য কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পরি। আমরা সবাই অনেক গুলো চকলেট কিনে নিয়েছিলাম সেদিন ।
সবশেষে আমরা সিলেট শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আমাদের ফিরতি ট্রেনের টিকেট আগেই কাটা হয়েছিল। রাত ৯.৩০ মিনিটে আমাদের ট্রেন সিলেট থেকে ছেড়ে যাবে। সেই মোতাবেক আমরা সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে সিলেট ফিরে আসি। আমরা সবাই রাতের খাবার হোটেল "পাঁচ ভাইয়ে " সেরে নেই। তারপর আমরা ৯.০০ টার দিকে ট্রেনে উঠে পড়ি । পরদিন সকাল সাতটায় আমরা ঢাকায় পৌঁছাই।
বাড়ি ফেরা ঃ
ঢাকা পৌঁছানোর পর আমরা সবাই পুরান ঢাকার বিখ্যাত কাচ্চি খেতে পুরান ঢাকায় যাই। এটাই ছিল আমাদের সবার একসাথে কাটানো শেষ মুহূর্ত। সকাল ৯.০০ টায় আমরা একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজ নিজ গন্তবে বের হয়ে যাই।
বন্ধুদের সাথে কাটানো সময় গুলো কখনো ভুলার মত নয়। ফিরে আসতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল । নিজের মধ্যে যতটুকু ক্লান্তি তৈরি হয়েছিল তার বিন্দুমাত্র রেশ ছিল না। ইনশাআল্লাহ, কোন একদিন হঠাৎ করে আবারও আমরা বেরিয়ে পড়বো।
সমাপ্ত