সলো-ট্রাভেলার হিসাবে ডরমিটরিতে অন্যান্য ভ্রমণকারীদের সাথে থাকার ব্যাপারটা আমার কাছে বাকেট-লিস্টেরই একতা অংশ ছিল! ধারণা করেছিলাম হয়তো ভারতে গেলে তখন সে সখ পুরণ হবে, বাংলেদেশেতো আর সম্ভ না। তাই সিলেটে যাবার জন্য হোটেল খুঁজতে যেয়ে বুকিং-ডট-কম'এ একটা ডরমিটরি দেখে একই সাথে অবাক এবং উৎফুল্ল হলাম।
আমি যখন Nazal Budget Hostel ডরমিটরিতে পৌঁছালাম তখন প্রায় দুপুর দুইটা।
আমি এর আগে কোনোদিন শুনিওনাই বাংলাদেশে ডরমিটরির ব্যবস্থা আছে। তাও আবার সিলেটের মত রক্ষণশীল এলাকায়!
কুয়াকাটা বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রিক জায়গাগুলার মাঝে মুখ্য। অথচ সেখানে আমাকে একা মহিলা হিসাবে হোটেল পেতে যা ঝক্কি পোহাতে হয়েছে! বাংলাদেশ এখনো সবখানে একা মেয়েকে হোটেল ভাড়া দেবার মত স্বাভাবিকতায় আসতে পারেনি, সেখানে ডরমিটরিতে থাকতে পারারতো প্রশ্নই আসেনা! কারণ সাধারণত ডরমিটরিতে এক রুমে ৮/১০টা বাংক-বেড থাকে যাতে ছেলে মেয়ে উভয়েই থাকতে পারে।
যেহেতু একা ছিলাম, হোটেলে উঠার চেয়ে মনে হলো ডরমিটরিই ঝামেলাহীন, নিরাপদ হবে। আর সেই সাথে কৌতুহলীতো ছিলামই।
কিন্তু নযলের মালিক সামি সাহেবের সাথে যখন কথা বললাম, উনি জানালেন ডরমিটরিতে পুরুষ-মহিলা রুমের বাইরে কমন বাধরুম। আর সবচেয়ে বড সমস্যা, বর্তমানে কোনো মেয়ে নেই তাই আমার বুকিং নিতে পারছেন না। আর "ছেলেদের সাথে শেয়ার করে থাকার প্রশ্নই আসেনা" বাক্যটি উহ্য থাকল কিনা বোঝা গেলোনা।
কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা উনাকে ধরে বসলাম, যে না আমার বুকিংটা নিতেই হবে আমি হোটেলে উঠতে চাইনা। শেষে উনি ৩বেডের পুরো একরুম আমাকে দিয়ে দিলেন ডাবল ভাড়ার বিনিময়ে। (অর্থাৎ ডরমিটরিতে পার-বেড হিসাবে ভাড়া ধরা হয়। সে হিসাবে বলতে গেলে আমাকে ৩বেডের পরিবর্তে ২ বেডের ভাড়া দিতে হচ্ছে, বিনিময়ে পুরো রুম আমার!)
হোটেলের পারিপার্শ্বিক, নিরাপত্তা আর সার্বিক স্বাচ্ছন্দ্যের বিবেচনায় "নযল" ডরমিটরিকেই আমার অগ্রাধিকার দেয়া যায় মনে হলো।
শ্রীমঙ্গল থেকে হেলেদুলে রওনা দিয়ে সিলেট পৌঁছাতে সেদিন দুপুর হয়ে গিয়েছিল। সামি সাহেব বললেন তিনি থাকবেন না, তার ছোট ভাই থাকবেন।
ডরমিটরির অবস্থানও বেশ ভালো জায়গায়, খুঁজে পেতে একদম অসুবিধে হয়নি। ওখানে যেতেই হালকা-পাতলা ছেলেটি অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
লাদেন।
আমার আসার কথা জানত। কথাবার্তা বলে ভেতরে নিয়ে গেল। জানলাম সামি সাহেবের ছোট ভাই ও। খুব সাধাসিধে ছেলে, অনেকটা ধার্মিকও বটে! আমার দিকে সরাসরি তাকাচ্ছিলেন না পর্যন্ত!
লাদেন বললো, "কিচ্ছুর চিন্তা করবেন না আপু। আমাদের এখানে একজন সর্বক্ষণ থাকে। কিছু লাগে খালি ওকে বলবেন! বা আমি আছি, আমাকে বললেও হবে।"
শুদ্ধ বাংলায় খাঁটি সিলেটি টান বেশ শ্রুতিমধুরই শোনালো! তখন শীতকাল। আমি হেসে বললাম
"আপাতত আমার এক পাতিল গরম পানি দরকার গোসলের! কিভাবে পাওয়া যায়!?"
"আপনি চেক ইন করেন রুমে, আমি বসিয়ে দিচ্ছি চুলায়। এখনি হয়ে যাবে।"
গরমপানি দিয়ে ঘষে ময়লার পরত তুলে তরতাজা একখানা গোসল দিয়ে, ফুড পান্ডায় ডাল-ভাত আর গরুর গোস্তো অর্ডার করলাম। আমার ইন্দ্রিয় বলছিল যে সিলেটি গরুর গোস্তো রান্না আমার স্বাদে মিলবেনা। ঠিক তাই হলো! তবুও যাত্রার ধকলে ক্ষুধার্ত থাকায় মোটামুটি উপাদেয় হিসাবেই খেলাম।
খেয়েদেয়ে সন্ধ্যা করে রওনা দিলাম SUST'র গেটের সামনের কফি খেতে।
সাস্টের গেটের সামনের এই ছোট্ট রেস্টুরেন্টের খাবার যেমন অতুলনীয় আবার দামও তেমনি সাধ্যের মধ্যে।
অত স্বল্প মূল্যে অমন দারুণ খাবার হয় না আর! দাম আর স্বাদে ব্যাটে বললে এমন মিললো যে, মুঘল আমলের ফুড-টেস্টারের মত ক্যাফেটায় খাদ্য চেখে দেখার চাকরি নিয়েছি বলে মনে হলো!
খেয়ে দেয়ে হালকা করে রাতের জন্যও নিয়ে নিলাম।
যেয়ে দেখি লাদেনের জায়গায় আরেকজন এলো।
ফাহিম। আমি কক্সবাজার থেকে এসেছি সে প্রসঙ্গে জানলাম কক্সবাজার চাকরি করেছে ফাহিমও। আর তার সাথে পিচ্চি সুমন। ক্লাস নাইনে পড়ে। চটপট করে কথা বলে যেমন, কাজও করে তেমন। দুজনের বাড়িই সুনামগঞ্জে।
সবচে বড় কথা আমার স্বাদের সাথে মেলে এমন চা বানাতে পারে এমন লোক হাতে গোনা।
চা খাবার সময় আমার জিহ্বার স্বাদের মাত্রা এতই সক্রিয় থাকে যে বেশীরভাগ সময়ই কোথাও চা খেয়ে শান্তি পাইনা। অথচ সুমনকে শুধু "একটু লিকার কড়া দিও" বলাতেই ও এত চমৎকার চা বানালো যা বলাই বাহুল্য!
কথায় কথায় ফাহিম আমাকে ভাত খাবার দাওয়াত দিয়ে ফেলল। আমিও কড়া করে বেগুণ ভাজা আর ডাল সাথে টমেটোর চাটনি দেখে হাভাতের মত সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম! ঘণ্টা দুয়েক আগেই যে মুঘলাই বাবুর্চির মত পেট পুরে খেয়ে এলাম সে কথা কাউকে জানালাম না!
ব্যস! জবরদস্ত একটা খানা দেবার পর সুমনকে বললাম আবার এক কাপ চা দিতে!
অমন নিশ্চুপ রাতে, ঘরোয়া পরিবেশের মত ছাদে বসে ঠান্ডা বাতাসে চা খাওয়াটা বেশ উপভোগ্য ছিল।
ঠান্ডা বাতাসে, নিস্তব্ধ রাতে, অচেনা সে শহরের ছাদে, বসে চা খাওয়ার সে অনুভূতি অনবদ্য।
মনে হলো, কোথাও যাবার কি দরকার, এইখানেই কিছুদিন আলস্যে কাটিয়ে দেয়া যাক!