দেবুদা'কে নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ নেই। বিশেষত উনার পাহাড়-পর্বত নিয়ে উন্মোত্ত নোম্যাড জীবন নিয়ে।
আমি যখন থেকে পাহাড়-পর্বত, বন- বাদাড় চিনেছি,দিনের পর দিন পাহাড়, ঝর্ণা, বন্যতায় ঘেরা প্রকৃতির মাঝে সার্ভাইভাল গেম খেলা শিখেছি; তখন থেকে দেবুদার গল্প শুনতাম এরওর মুখে এক কিংবদন্তীর মত।
চিটাগং শিল্পকলা একাডেমী ছিল ভার্টিক্যাল-ড্রিমার্সের আড্ডাখানা। কোনো এক অজ্ঞাত কারনে উনার সাথে সামনা সামনি দেখা হতে যেয়েও দেখা হয়নি কখনো আজকের আগে।
আমরা যাচ্ছি এক লম্বা সফরে এবার। শুরুতে গন্তব্য রেমা কালেঙ্গা অভয়ারণয়্য।
উনি যখন বাসে উঠে এসে আমার পাশে বসে পড়ে শুধোলেন “আরে মৌ! কী অবস্থা!”
উনি আমাকে চেনে! উনি আমার নামও জানে! সারারাত আমার পাশে বসে হবে এ যাত্রা! উনি বন্ধুভাবাপন্ন পরিবেশও দিচ্ছে! সব মিলিয়ে এত চমক হজম করতে আমার তখন নামে মুখে এমনকি কানেও বিষম লাগে অবস্থা।
কখন যে আমরা গল্পে মত্ত হয়েছি টেরও পাইনি। সে গল্প ছোট্ট দেবুর বনে হারিয়ে যাওয়া থেকে তারুণ্যে এসে নাগ পাহাড় কি আর মাউন্টেইন কি… সব দাপিয়ে বেড়ানো দেবুদা'র সাথে তি.গো., মাসুদরানা আর সেবার নস্টালজিয়ায় ডুবে ভেসে শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছালাম, তখন প্রায় ভোর।
সবাই নেমে সেখান থেকে সিএনজি ভাড়া করে, বেশ দুমড়ানো মুচড়ানো রাস্তা পাড়ি দিয়ে সোজা চলে গেলাম রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের ডাকবাংলোয়।
যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য উঠে গ্যাছে।
ডাকবাংলো শব্দটাতে আমার বেশ রোমাঞ্চ লাগে।ছোটোবেলায় কিশোর ক্লাসিক বা গোয়েন্দা গল্পগুলোয় ডাকবাংলো খুবই কমন একটা প্লট!
ভয়ানক আর ভৌতিক সব ব্যাপার ঘটতো বিভিন্ন ডাকবাংলোয়!
আর যেহেতু এই প্রথম গল্পের প্লটের সেই ডাকবাংলোয় থাকবো, ব্যাপারটায় কিশোরীদের মত রোমাঞ্চ অনুভব করলাম।
একটু হতাশই হলাম!
যেয়েই সবাই ঘন্টাখানেক ঝিমিয়ে নিলাম।
বাংলোর কেয়ারতেকার দুজন সকালের নাস্তা তৈরী হয়ে যাবার খবর দিতেই, সবাই মোটামুটি জাতস্থ হয়ে খেতে গেলাম।
ডিম-পরোটার পর ফার্স্টক্লাস এক কাপ চা খেয়ে সবাই বেরিয়ে পড়লাম অভয়ারণ্য অভিযানে!
অভয়ারণ্য দেখার সুযোগও এবারই প্রথম পাওয়া।

খোলা বনে বিচরণ করা পশু পাখীদের মাঝে বেশ একটা এডভ্যাঞ্চার হবে!




কিন্তু আমাদের সংগী পুরুষগণ আশেপাশে কোন পুকুরে গোসল করতে যাওয়ায় আমি আর শুভ্রা ভাবীকে খিদের চাষ অব্যাহত রাখতেই হলো!
শেষমেশ ঘুমিয়েই গেলাম!
ফরহান ভাই এসে আমাকে আর ভাবীকে ডেকে নিয়ে গেলেন খেতে বাংলোর পাশে কিছু মিটার দূরে রান্নাঘরের সাথে লাগোয়া ডাইনিঙে!
আমরা যেতে যেতে দেখলাম ক’জনের দু'তিনটে মুরগীর টুকরো কষে চাবানো শেষ!
নিঃসন্দেহে অসাধারণ রান্না!
দেশী মুরগীকে মশলা আর তেলে চটকে রান্না, হালকা গ্রেভী ঝোল আর তারউপর গেরস্থের ঘরের সেদ্ধ চালের ভাত...আহা!

প্রায় দু'দিনের ভাত না খাওয়া আমি খুব ধীরে সুস্থে আরাম করে তৃপ্তি নিয়ে খেলাম!
পূর্ব রাতের দীর্ঘ যাত্রার নির্ঘুমতা ও সকালের অভিযান শেষে এমন আয়েশী খাবার পর কোন পাগলে ডাক বাংলোর ভাত ঘুম রেখে অন্য কোথাও যাবে!
তাই খেয়ে দেয়ে সবাই “সাতছড়ি” রওনা দিলেও, আমি, শুভ্রা ভাবী আর দেবুদা থেকে গেলাম!
৩জনে চা’এর কাপ নিয়ে আরাম করে বারান্দায় গল্প করতে বসে গেলাম!
গল্পের এক ফাঁকে ভাত-ঘুম আর আটকে রাখতে না পারতে আমি উঠে ঘুমুতে চলে গেলাম!
মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে দেখি সন্ধ্যা!
অন্ধকার আর নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে পুরো ডাকবাংলো।
বুঝলাম আমাদের অভিযাত্রীদল এখনো ফেরেনি!
সম্বিত ফিরতেই বুঝলাম আমি যে গন্ডারের চামড়াজাত, মশার কামড়ে না আসলে খিদেয় ভেঙেছে ঘুম! চোখ কচলে উঠে বসতেই ভাবীর গলা পেলাম-
ঃ “উঠে গেছো মৌ! ভালো হয়েছে, আমি চা-এর কথা বলে এলাম, তোমাকে ডাকতেই আসছিলাম!”
আমার বড়ভাই নেই বিধায় কখনো “ভাবীর আহ্লাদ” জিনিসটা পাওয়া হয়নি। তাই শুভ্রা ভাবীর এই আহ্লাদে মনে মনে বেশ এক প্রস্থ সুখ উপভোগ করে নিলাম! আরো এক বাক্স আহ্লাদ ঢেলে বললাম,
ঃ “ভাবী খিদে পেয়েছে!“
ঃ “আরে আমারও! কিছু ব্যবস্থা করা দরকার”
চোখ কচলে উঠে দেবুদার খোঁজে গেলাম। যেয়ে দেখলাম, উনি আমাদের ঘুমানোর সুযোগে নান্দা-দেভ বইখানা উপভোগ করছিলেন বেশ!
ঃ “ও দেবুদা! খিদে পেয়েছে খুব!” ()
ঃ “খিদে পেয়েছে না! দাঁড়াওতো আমার কাছে বিস্কুট থাকার কথা!”
চা চলে এলে সেই বিস্কুট দিয়ে কোনমতে কাজ চালিয়ে নিলাম।
পরে আবার কেয়ারটেকারদের একজনকে দিয়ে ছোলামুড়ির খোঁজে পাঠালাম। আশেপাশের বাজারও বেশ দূরে তাও আবার সে বাজার সম্ভবত সন্ধ্যায় পাট চুকিয়ে ফেলে!
আশা নিরাশার দুলতে দুলতে আমাদের গল্পের মাঝেই ছোলামুড়ি এসে গেলো!
খেয়ে দেয়ে আবারও চা এর ফরমায়েশ!
ভাবী ক্ষ্যামা দিলো কিন্তু আমার আর দেবুদার কাপের পর কাপ চা চললো!
.
একসময় চা এর কাপ নিয়ে বারান্দায় চলে এলাম।
আমাদের এই বাংলোর আশেপাশে আর কোনো “ঘর” জাতীয় কিসসু নেই।
চারপাশ নিকষ অন্ধকারে ডুবে আছে যার মাঝে একটুকরো আলো মাথায় করে দাঁড়িয়ে আছে এই ছোট্ট ডাকাবংলোটা। সকালে যে কিঞ্চিৎ হতাশা ছিল, সেটা এই আবহে কেটে গেলো নিমেষেই।
অনুভব করলাম নেটওয়ার্কবিহীন, সভতা থেকে বহু দূরে, শ শ মিটার উচ্চতার কোনো ম্রো পাড়ার জুম ঘরে বসে চা খাওয়া আর এই সভ্যতার অভ্যন্তরে, নেটওয়ার্কের আওতায় সমতলের এই ডাকবাংলোয় চা খাবার মত দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী পরিস্থিতি হলেও এদের মাঝে অদ্ভুত মাদকতা পূর্ণ এক সাদৃশ্য আছে!
একটা কেমন বিস্কুটের মত অচেনা ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে!
কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম জঙ্গল থেকে কোনো রকম আওয়াজ পাওয়া যায় কিনা!
মনে হলো যেনো এই অন্ধকারের এক ভাষা আছে, কি যেন বলে চলেছে অবিরাম!
সে অদ্ভুত এক অনুভুতি, এর নামকরণ করার মত কোন নাম খুঁজে পেলাম না।
সে সম্মোহনীয় ঘোর কাটল হৈচৈ করে যখন আমাদের অভিযাত্রীদল ফিরলো!
নৈশভোজ আর আড্ডার পর আমাদের অভয়য়ারণ্যের অভিযানের এখানেই ইতি টানলাম।