সমরেশ মারা গেলেন কিছুদিন আগে। যেরকমটা ইদানিংকালে যেকোনো সেলিব্রিটি মারা গেলেই হয়, বেশ ভালোরকম লেখালেখি হলো তাঁকে নিয়ে, আলোচনা, সমালোচনা দুই-ই হলো।
মৌষলকাল বহুদিন ধরে চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করলেও, পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিলোনা। কারন, উত্তরাধিকারেই বোঝা গেছে যে, কালপুরুষের যে তেজোদীপ্ত আমাদের মাধবীলতা আর অনিমেষের, তাদের বেলা পরে এসেছে।
তবে, সেটাই ছোট্ট অর্র্ক'র অভ্যুত্থান পড়তে খারাপ লাগেনাই। কিন্তু আবার অনিমেষের সে আবির্ভাব, নকশালের মত উত্তাল সমুদ্র থেকে পরে আসা, খুঁড়িয়ে যাওয়া বেলার মতো করে ওকে গ্রহণ করতে ইচ্ছে করেনি।
অনিমেষকে অদম্য, দুর্বিনীত, তারুণ্যের উত্তেজনায় সমুজ্জ্বলই রাখতে চেয়েছি মানসপটে।

His best works
মাঝে মাঝে মনে হয় লেখকরা এত কিছু লেখেন, এত কিছু বোঝেন কিন্তু পাঠকের মন কদাচিৎ বোঝেন!
আমার কাছে "মৌষলকাল'টা" অন্তত ওরকমই লেগেছে, কালপুরুষ ট্রিলোজিটাকে কচলে কচলে তেতো বানানো।
সাতকাহনেও ২য় খন্ডে এসে একটু বিরক্তি হয়েছিলাম। "গর্ভধারিণী"তেও সেরকম না হলে, মনে হয়েছিল যে আশা দিয়ে শুরু হয়েছিল জয়িতাদের যাত্রা, ঠিক হাওয়াটা সেদিকে না যেয়ে হঠাৎ যেন জবরদস্তি মোড় ঘুরিয়ে নিল।
ঐদেখ কোত্থেকে কই চলে যাচ্ছি।
আমাদের অফিসে ডেস্কে যতক্ষণ থাকি, আশেপাশে কোনো মোবাইল বা এমনকি একটা বইও রাখা যায় না। এর মাঝে কাজের ফাঁকে বসে বসে বিরক্ত হয়ে শেষে পিডিএফ ইমেইলে বই পড়বার অন্তত একটা ব্যবস্থা করলাম কয়েকজন মিলে চুপিচুপি।
অথরিটি টের পেলে রক্ষে থাকবেনা। কিন্তু কাজহীন সময়টায় কেবল বসে থেকে ফাঁকা স্ক্রিনের দিকে আর কতক্ষন তাকিয়ে থাকা যায়। তো কয়েকজন মিলে বই চালাচালি করতাম। পিডিএফ ফাইলের যা হাহাকার চলছে তার মাঝে সেজন্য যা পাচ্ছি তাই পড়ছি, একেবারে বাছবিচার ছাড়া বলা চলে।
তার মাঝেই ঘুরতে ঘুরতে কার থেকে যেনো দেখি একদিন এসে গেল "মৌষলকাল"
বলা যায় একান্ত একঘেঁয়েমী কাটাতেই বইটা তুলে নেয়া এত বছর পর।
এবং যা ভেবেছিলাম, ভালো লাগেনাই। অতো যুক্তি তর্কের অবকাশ থাকলেও, সমরেশের উপর আস্থা ছিল যে একেবারেই কেলো করে ফেলবেনা।
কিন্তু ভুল হলো। আমি কেবলই ভাবছিলাম কেন লিখলেন।
থাকতো ওভাবেই কল্পনাতে, উত্তরাধিকারেই শেষ হতো বাকিটা অনুক্ত থাকলেই বেশ হতো নয় কি?
বই পড়ে মনে হলো অনিমেষের উপর জমা ক্ষোভ ঝাড়লেন এই বইটি লিখে। যেন রাজনীতিকে উপলক্ষ করে বলতে না পৰ আক্ষেপ উনিই অনিমেষের মাধ্যমে প্রকাশ করলেন।
তুমি বুড়িয়ে গ্যাছো, অনিমেষ।
তোমার খুঁড়িয়ে যাওয়া পায়ের সাথে খুঁড়িয়ে গ্যাছে নকশালও। সেই ধারায় নেতিয়ে গ্যাছে কংগ্রেস, সিপিএম করে চুনোপুঁটিরা হয়েছে রুই-কাতলা।
তুমি নকশালকে সর্র্বস্ব দিয়ে ভালবেসে আঁকড়ে ধরলেও, নকশাল কেবল তোমাকে দিয়েছে অবহেলা আর গঞ্জনা। অথচ তবুও বিষাক্ত এ প্রেমে পড়েই রইলে যুগযুগ ধরে।
সিপিএমের রাজত্ব শেষে এখন ত্রিণমূল এখন ক্ষমতায় আসবে। এটাও তোমার মনঃপুত হচ্ছেনা। তোমার ওসব সস্তা কমিউনিজম আর মাও-বাদ এই মূর্খদের দেশে চলবেনা। তোমার কথাই যদি লোকে না বোঝে তবে আর তাদের উত্তরণে কাজ করবে কিভাবে।
সমরেশের বোধকরি সব বই-ই রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়ে। অন্তত যতগুলো পড়েছি তার মাঝে একটা ছাড়া সবই তাই। অবশ্য সেটাতেও সূক্ষভাবে সমাজনীতি একেবারেই ছিলোনা বলা যাবে না।
খেয়াল করে দেখলাম সমরেশ যেভাবে মেয়েদের নিয়ে লিখেছেন, তার যে একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা ছিল এই ব্যাপারটা আমার বেশ ভালো লেগেছে।
একজন পুরুষ হয়ে মেয়েদেরকে উপলব্ধি করতে চাইবার এবং তা তার লেখায় তুলে ধরবার যে প্রচেষ্টা সেটাতে আমার খুব আহ্লাদ লাগে।
সমরেশের বোধহয় প্রথম বই পড়েছিলাম যখন কলেজে পড়ছি। নামও মনে আছে বইটার।
"এই আমি রেণু।"
যে বন্ধুটি পড়তে দিয়েছিল, সে উনার পাঁড় ভক্ত ছিল। ওর হাত দিয়েই আস্তে অনিমেষ-মাধবীলতার অধ্যায়ে ঢোকা।
ওদের বয়সেই ওদের কথা পড়তে যে এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাবার আবেশ, এটা বেশ পুলকিত করেছিল।
আমাকে সে বলতো "তুই মাধবীলতা'র মতো জানিস!"
এখন সে কথা কেউ বললে হতো চটে যাব নির্ঘাত কিন্তু তখন আমার মাঝে মাধবীলতা খুঁজে পাবার ব্যাপারটা বেশ আহামরি ছিল।
এইটা ঠিক সমরেশ অনেক কিছু বলতে লিখতে চাইতো কিন্তু সালমান রুশদির একঘরে হতে চায়নি সে। এক নির্দিষ্ট জায়গা অব্দি গিয়ে আকস্মিকভাবে মোড় ঘুরিয়ে নিত। যদিও সে দীপাবলি (সাতকাহন) বা অনিমেষ-মাধবীলতা (কালপুরুষ-কালবেলা-উত্তরাধিকার-মৌষলকাল) কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে জয়িতা (গর্ভধারিনী)র জন্যই খ্যাত বেশী, কিন্তু আমার কাছে ওঁর সবথেকে চমৎকার কাজ লেগেছে "আট কুঠুরি নয় দরজা" বইটা।
সমরেশের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমারও শেষ হলো সমরেশের অধ্যায় (চর্চা)
যদিও সমরেশ বাংলাদেশে এসেছিলেন বেশ ক'বার এমনকি আমাদের পাশের বাতিঘরেই, আমার কখনো যাওয়া হয়নি সে সমাবেশে।
ইচ্ছে করেই।
আমার ইচ্ছে করে, কিছু মানুষকে বই চরিত্রের মতোই কাল্পনিক রেখে দিতে।
ধরাছোঁয়ার বাইরে, বইয়ের চরিত্রের মতোই কাব্যিক দূরত্বে রাখতেই ভালো লাগে।
কিন্তু এখন যখন উনি অস্তিত্বের জানান দিয়ে বিলীন হয়ে গেলেন, মনে হয় দেখা হলে কেমন হতো। অনেক ভক্তের ভীড়ে নিশ্চয় গল্প খুব একটা হতোনা।
অল্প কথা বলে কিংবা চোখের দেখায় কি সাধ মিটতো?
All the contents are mine until mentioned otherwise.