ভাওয়াইয়া গানে গাড়ির ছই ও নারীহৃদয়

'গাড়ির ছই দেখিয়া মন মোর কান্দে রে '
দূর-দূরান্তর বিয়া দিয়া মোকেও (মোকে-আমাকে) গেছে ভুলি ' নারীহৃদয়ের এই চিরন্তন বিচ্ছেদ বেদনার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে উত্তর বঙ্গের ভাওয়াইয়া গানে। ভাওয়াইয়া গানে বাহন হিসেবে বেশিরভাগই ব্যবহৃত হয়েছে গাড়ি। এই গাড়ি বলতে বোঝানো হয়েছে গরুর গাড়ি। শুধু গরুর গাড়িই নয় মহিষের গাড়িও এতে বোঝানো হয়। উত্তরবঙ্গে নদীনালার চেয়ে আবাদি জমিই বেশি। একারণে মানুষের চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হতো গরু বা মহিষের গাড়ি। মাটির রাস্তায় চলত ওইসব গাড়ি। রাস্তার নানা কন্ডিশনে গাড়ির কাঠ দিয়ে বানানো চাকার বিচিত্র শব্দ হতো। অসাধারণ সাংগীতিক সেই শব্দ। সেলিম আলদীন তাঁর 'চাকা' নাটকে এই শব্দের ব্যবহার করেছেন। গ্রামের পথে গাড়ি ছিল বহুল ব্যবহৃত বাহন। এখনো সেই গাড়ি অনেক জায়গায় আছে। গাড়ির উপরে বাঁশের চাঁটাই দিয়ে বানানো হতো গোলাকৃতির ঢাকনা । এই গোলাকৃতি আবৃত করা হতো ররংবেরং এর কাপড় দ্বারা। একেই বলা হতো ছই। গাড়ির ছই দেখে বিবাহিত নারীর পিতৃগৃহে বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে পড়তো। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে মেয়েদের চিরদিনের জন্য চলে যাওয়ার নির্মম নিয়মের আর্তনাথ ফুটে উঠেছে উত্তরবঙ্গের বহু ভাওয়াইয়া গানে। দক্ষিনবঙ্গে এই বেদনা ফুটে উঠেছে ভাটিয়ালি গানে ব্যবহৃত নৌকার ছইয়ে।
উত্তর কিংবা দক্ষিণ উভয়বঙ্গের এই চিত্র একই রকম। বিয়ের পর পিতৃগৃহ বলা চলে চিরদিনের জন্য বাদ হয়ে যেতো। এরপর পিতৃগৃহে শুরু হতো ভাইয়ের সংসার। কিন্তু বিয়ের পর বিদায় হয়ে যাওয়া নারীর স্বামী যদি অকালে মারা যেতো কিংবা সংসারে বিচ্ছেদ ঘটতো
তাহলে সেই নারীর পেছনে ফেরার আর কোনো পথই খোলা থাকতো না। ভাইদের সংসারে তার জায়গা হতোনা বললেই চলে। এমনও হতো স্বামীর বাড়িতেই বা অন্য কোথাও তাকে আশ্রয় নিতে হতো যেটা তার স্বাভাবিক জীবন ছিল না । গোটাদেশে এই নারীর সংখ্যা কখনোই কম ছিল না। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে এই রীতিতে নারীর অবস্থান ছিল অপাংক্তেয়। সেই সমাজটার ভেতরটা কিন্তু আজ অবধি খুব একটা বদলায়নি। এখন গাড়ি কমে গেছে, অনেক পাকা রাস্তা হয়েছে সেখানে চলাচল করে বাস, কার। পাকা রাস্তা এবং যানবাহনের উন্নতিকে আমাদের দেশে এখনও সবচেয়ে বড় উন্নয়ন হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু নারীর পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানগত মননকাঠামো রয়ে গেছে সেই ছই দেখে কেঁদে ওঠার আমলে। স্বামীগৃহে এখনো শিক্ষিত মেয়েদেরও চিরদিনের জন্য চলে যাওয়া না বোঝালেও ফেরার পথ খুব একটা উন্মুক্ত নয়। এর মধ্যে অনেকেই চাকরি-বাকরিও করে কিন্তু সাংস্কৃতিক যে ছই আমলের অবস্থান সেটার বদল ঘটেনি।