গতমাসে দুইদিনের জন্য রাজশাহী ঘুরতে গিয়েছিলাম। সবাই যেমন বলে রাজশাহী সুন্দর, ছিমছাম, গোছানো শহর, আসলেই তাই। ঢাকা শহরে রাস্তার পাশে ময়লা দেখে অভস্ত মানুষদের জন্য তাই এ জায়গা এত পরিপাটি লাগে। রাজশাহীতে ঢুকেই আমের মুকুলের যেই মোহনীয় সুবাস পাচ্ছিলাম সেটা আমাদের আম গাছের ধারের কাছেও না। এর কারণও আছে। রাজশাহীতে একেকটা আম গাছের পেছনে অনেক খরচা করা হয়। বছর জুড়ে গাছের চারপাশে মাটি খুঁড়ে নানা সার দেয়া হয়, যার জন্য এত ভালো ফলনও হয়।

বলেন তো এটা কি গাছ? উত্তর পোস্টের শেষে দেয়া আছে।
তো রাজশাহী দেখা শুরু করলাম পদ্মার পাড় দিয়ে। একদম ভোর সাড়ে ৬ টায় বের হয়ে গিয়েছিলাম কারণ ৮ টা বাজতেই রোদের ভয়ংকর আচ টের পাওয়া যায়। আমরা মার্চের মাঝামাঝিতে গিয়েই রোদে পুড়ে যেই হাল হয়েছিলো (ঢাকায় তখনও রাতে কাথা নিতে ঘুমাতে হতো) এখন গেলে বারবিকিউ হয়ে ফেরা লাগতো। তো এজন্যই যত সকালে রওনা দেয়া যায় আরকি। শীতের শেষে বলে নদীর পাড়ে চর উঠে গিয়েছিল, একদম শাটিকাপের ভাইব পাচ্ছিলাম (শাটিকাপ রাজশাহীর মাদক ব্যবসায়ী চক্র নিয়ে তৈরি চমৎকার একটি ওয়েব সিরিজ)।

এত বিশাল পদ্মার পাড় দেখে কি যে শান্তি লাগছিল! ভোরে যাওয়ার ফলে টুরিস্টও খুব কম ছিলো।

পদ্মার পাড়ের মুসুরির ডাল!
পদ্মার পাড় থেকে ফিরতে গিয়ে রোদে খারাপ লাগা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সাহেব বাজারের মেইন রাস্তায় উঠেই দেখি ঘোষ বাবু মাঠা নিয়ে বসেছে,

এত হেঁটে আসার পর এই জিনিস পুরা টনিকের মত কাজ করেছিলো।
তখনই রাস্তার পাড়ে দেখলাম এক চাষী হাটে মিষ্টি কুমড়া নিয়ে যাচ্ছে।

একেকটা মিষ্টি কুমড়া প্রায় ৭০ কেজি! এমন বিশাল সবজি বাইরের দেশে দেখেছি কিন্তু এখানেও যে চাষীরা এমন উৎপাদন করতে পারে জানা ছিলো না।
অটোতে করে ফেরার সময় দেখলাম দলবেঁধে মানুষ সাইকেল নিয়ে কাজে যাচ্ছে। এখানকার অধিকাংশ মানুষই সকালে সাইকেলে করে কাজে যান, যার জন্য গাড়ির চাপও কম।

প্রায় সাইকেলের সামনে বেতের বানানো ঝুড়ি আছে যেই জিনিসটা অন্যকোথাও দেখি নাই।
সময় যেহেতু দুইদিন তাই সেদিনই আবার নাটোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

নাটোরে দেখার মত আছে উত্তরা গণভবন, পুটিয়া জমিদার বাড়ি, মন্দির আর বাঘা মসজিদ। এর মধ্যে আমার সব থেকে ভালো লেগেছে পুটিয়া জমিদার বাড়ির মন্দির। অসাধারণ টেরাকোটার কাজ। আমার অনেক দিনের শখ ছিলো কান্তজির মন্দিরের মত এমন টেরাকোটার কাজ সামনে থেকে দেখার।

এখানে একেকটা টেরাকোটা সনাতন ধর্মের রামায়নের রাম রাবণ, মহাভারতের রাধা কৃষ্ণ এমন নানাধরণের কাহিনী নিয়ে তৈরি করা করেছে।
নাটরের বিখ্যাত মিষ্টি হলো কাচাগোল্লা।

আমি খেতে পারি নাই, এত টুকু ছানাতেই মনে হচ্ছিলো ১কেজি চিনি ঢেলে দিয়েছে, ছানা যাতে সংরক্ষণ করা যায় এজন্য চিনি বেশি দেয়া হয়।

সব ঘুরে এসে বিকালে রাজশাহীর বিখ্যাত সপুরা সিল্কে গিয়েছিলাম। এখানকার একেকটা সিল্কের ওড়নাই ২/৩ হাজার টাকা!
এরপরের দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখলাম। বিশ্ববিদ্যালয়টিও খুব ছিমছাম, কিন্তু সবখানেই রাস্তার কাজ করছিলো বলে ধুলার পরিমাণ একটু বেশি ছিলো।

এই সেই বিখ্যাত পারিস রোড। রাজশাহীর এই একটা জায়গাতেই গরম লাগেনি। বহু পুরোনো বিশাল বিশাল গাছ সবসময় একটা শান্তিময় পরিবেশ তৈরি করে রাখে।

শেষমেস পুরো বিশ্ববিদ্যালয় দেখে বাসায় ফিরলাম।
আমার রাজশাহী ঘুরে সবথেকে বেশি টেনেছে যেই জিনিসটা সেটা হলো এখানকার মানুষের আন্তরিকতা। একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। শেষ দিন রাতের বেলা রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাসায় ফেরার জন্য অটো দেখছিলাম। রাত বেশি হয়ে গিয়েছিলো বলে তেমন কিছুই পাচ্ছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা অটো পাওয়া গেলেও নরমাল ভাড়ার থেকে ৫০/৬০ টাকা বেশি চাচ্ছিলো। কিন্তু অটো নামিয়ে দেয়ার সময় বললো, "আমি তো ভেবেছিলাম আরও ভেতরে যাবেন, এজন্য ১২০ টাকা চেয়েছিলাম, আপনি ৭০ টাকাই দেন, বেশি কেনো নিবো?" আমরা খুশি হয়ে জোরাজুরি করেও তাকে বেশি টাকা দিতে পারলাম না।
আসলে আমাদের শহরের এত অবিশ্বাস, প্রতারণা আর হয়রানির মধ্য দিয়ে বড় হওয়া মানুষ যখন এই নগর সভ্যতার বাইরে যায় তখন এমন ছোটখাটো জিনিসের মধ্যেও আন্তরিকতা খুঁজে পায়। অবশ্য শহরে জীবিকা ধারণ করাটাই এত চ্যালেঞ্জিং, সরল সহজ মানুষ হলে টিকে থাকাই দায়।
(ও গাছের সেই ছবিটার উত্তর এখন দেই, খুব ভেবেছিলেন এটা আম গাছ তাইনা? আসলে লিচু গাছ 😛)