একদম প্রথম বর্ষের দিকে তাকালে মনে পড়ে এক্সাম শেষে দল বেঁধে ঘুড়তে যাওয়া। শিল্পকলা, বাংলা একাডেমি বা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের অডিটোরিয়ামের সামনের দাঁড়ায় সিনেমা বা নাট্য সপ্তাহের সূচি মুখস্থ করা, ডিপার্টমেন্টের টিচারদের মিমিক্রি কে সবথেকে ভালো করতে পারে সেটা নিয়ে যুদ্ধ করা, একমাস ধরে নবীনবরণের আয়োজন করা, ডিপার্টমেন্টের পিকনিক গুলোতে ধুমায় লাফালাফি করা, আরও কত কি!
আমাদের ক্লাস শেষে প্রতিদিন যেই সিদ্ধান্ত নিতে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হতো তা হলো "আজকে কোথায় গিয়ে খাবো"। ক্যাম্পাসে খাবারের জায়গার অভাব না থাকলেও " ভালো" খাবারের দোকানের বড়ই অভাব। স্বাদ বদলাতে তাই একেকদিন একেক জায়গায় হানা দিতে হতো। রেগুলার খাবারের জন্য টি.এস.সি., ডাকসু, আই.ই.আর. এর ক্যান্টিন বা চারুকলা। আর যেদিন একটু দামি খাবার খাওয়ার আউশ জাগতো সেদিন এফ.বি.এস., আই.বি.এ. আর সমাজ বিজ্ঞান তো আছেই।
ক্যাম্পাসে প্রায়ই সাজ সাজ রব থাকতো। দেশীয় উৎসবের দিনগুলোয় তো কথাই নেই। পহেলা বৈশাখ, বর্ষাবরণ, পহেলা ফাল্গুন, চৈত্র সংক্রাতি এ সবগুলারই আমেজ নিতে ছুটে যেতাম প্রতিবার। ঢাকার উপচে পড়া মানুষের ভিড় আমাদের দমিয়ে রাখতে পারতো না! এছাড়া জগন্নাথের স্বরসত্বী পুজা ছিলো দেখার মতন। একেকটি ডিপার্টমেন্টের মন্ডপ তৈরির জন্য প্রতিবার বিশাল অংকের বাজেট বরাদ্দ থাকতো। প্রতিটা মন্ডপ হতো একেকটার চেয়ে আলাদা, একেকটার চেয়ে সেরা। মন্ডপ ঘুরে এসে পুজা উপলক্ষে হলের স্পেশাল নিরামিষ ফিস্ট খাওয়ার মজাই ছিলো অন্যরকম।
আর আমার কাছে একুশের বইমেলা অনেকটা ঈদ ঈদ আনন্দ দিতো। মেলা শুরুর দুই সপ্তাহ আগে থেকেই সোহরাওয়ার্দীতে স্টল বানানোর কাজ দেখতাম। কোন স্টল বেশি সুন্দর আর সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে পেরেছে সেটা নিয়ে বান্ধবীর সাথে তর্ক হতো।
হল জীবন নিয়ে বলতে গেলে আমার জন্য এই দিকটা অন্য সবার থেকে একটু অন্যরকম। ক্যাম্পাস থেকে বাসার দূরত্ব ২ ঘন্টার ছিলো বিধায় হলে সপ্তাহে ২/৩ দিনের বেশি থাকা হতো না। কিন্তু এর মধ্যেই হলের বেশ কিছু মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছিলো। কিছু মেয়েকে দেখতাম দুপুরে ক্লাশ থেকে এসেই কে ড্রামা নিয়ে বসতো, কেউ হাড়িপাতিল আর মশলার কোটা নিয়ে ছুটতো ব্লকের করিডোরের চুলায় সিরিয়াল দিতে , আবার কেউ ল্যাব, টিউশন, ডিবেটিং ক্লাবের কাজ করে ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা। রাতের বেলায় হল গেট থেকে প্রায়ই তাদের দরজাটা একটু খুলে দেয়ার জন্য আকুতি শোনা যেতো, দারওয়ান দাদুর মনটাও পাষাণ ছিলো।
আমরা ক্যাম্পাসের নানা ধরণের প্রতিবাদেও সোচ্চার থাকার চেষ্টা করতাম। কোটা আন্দোলনের পুরোটা সময় হলে থেকে দেখেছি পক্ষে বিপক্ষের নানা ধরণের মানুষদের। হলের আপুদের যখন মিছিলে যাওয়ার জন্য ডাকা হতো আমার রুমমেট আপু তখন ভয়ে ছিটকিনি লাগাতো, আর তারই বেডমেট রাত দেড়টায় মিছিলে যাওয়ার জন্য বাকিদের সাথে হল ছাড়তো, আহত বন্ধুর জন্য ৩ বেলা রান্না করে ডি.এম.সি. তে খাবার নিয়ে দৌড়াতো, ফিরে এসে বসতো রাজুর নিচে। দিনশেষে রুমের সেই ভিতু আপুকেই দেখা যেতো আন্দোলন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করতে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে বলতে গেলে আরও কত কথা মাথায় আসে! এই ক্যাম্পাস জীবন শিক্ষার্থীকে সকল ধরণের উপকরণ দেয় যাতে সে একটা মননশীল সত্তা তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে কে কতটুকু নিতে পারে সেটাই মূল বিষয়!