সেদিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, যেদিন প্রথমবারের কোনো তিন গোয়েন্দার বই হাতে নিয়েছিলাম। তার আগে বন্ধুদের কাছে তিন গোয়েন্দার গল্প শুনলেও কখনো পড়া হয় নি। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীয় ছাত্র আর আমার বই পড়ার দৌড় ছিল বিভিন্ন স্কুলের সহপাঠ বইয়ের গল্পগুলো আর বিভিন্ন রকমের ম্যাগাজিন ও কিশোর কন্ঠ। বন্ধুদের আড্ডায় তিন গোয়েন্দা নিয়ে কিছুটা উৎসাহ দেখানোই একদিন এক বন্ধু আমাকে স্কুলের পাশের এক লাইব্রেরিতে নিয়ে যায়।লাইব্রেরির নাম ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি। সেখানে থরে থরে তিন গোয়েন্দার অসংখ্য বই সাজানো ছিল। শুধু তিন গোয়েন্দা না, মাসুদ রানা থেকে শুরু করে আরো নানা রকমের বই। এগুলো অবশ্য বিক্রী করা হতো না। ৫ টাকার বিনিময়ে একেকটা বই বাড়িতে নিয়ে পড়া যেত।
আমার তিন গোয়েন্দা পড়ার জার্নি শুরু হয়েছিল মূলত কাকাতুয়া রহস্যের মাধ্যমে। এর আগে কিশোর উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। তাই প্রথমবারের মত কোনো কিশোর উপন্যাস পড়ার সময় আমার প্রতিটি চরিত্রের উপর আগ্রহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে মূল তিন চরিত্র কিশোর, মুসা ও রবিনের উপর।
বিশেষ করে কিশোর পাশার প্রতি বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, যেহেতু একমাত্র এটাই বাঙ্গালী চরিত্র ছিল। মাঝে মাঝে তো নিজেকে কিশোর পাশা হিসেবে ভাবতেও ভাল লাগতো। কিশোরের মতো বিশেষ বিশেষ সময়ে নিচের ঠোটে চিমটি কাটার মতো অভ্যাসও হয়ে গিয়েছিল সে সময়।
ছোটবেলায় হাতে টাকা পয়সা তেমন থাকতো না। সে হিসেবে ৫ টাকাও আমার জন্য অনেক। প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় বাসা থেকে ৫-১০ টাকা পেতাম যাওয়া আসার খরচ বাবদ। টাকা বাঁচানোর জন্য বেশিরভাগ সময় হেঁটে হেঁটেই স্কুলে যাতায়াত করতাম। বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটারের মতো ছিল। সে হিসেবে প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মতো লাগতো। কিন্তু কখনো কষ্ট লাগে নি। বরং এই টাকায় নতুন একটা বই নিতে পারবো, সেটা ভেবেই আনন্দ হতো।
সেসময় তিনগোয়েন্দা পড়াটা একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। পড়া ফাঁকি দিয়ে সারাক্ষণ সুযোগ পেলেই বই নিয়ে বসে যেতাম। এজন্য অনেকবার বাড়ি ও স্কুলে মারও খেতে হয়েছে। কিন্তু নেশা তো আর ছাড়তে পারি না। বই একটা পড়া শুরু করলে সেটা শেষ না পর্যন্ত শান্তি লাগতো না।
সত্যি বলতে কী, তিনগোয়েন্দা আমার কিশোর কালে অনেক ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। আমাদের জীবনটা আরো রঙিন করে তুলেছিল। প্রতিদিন স্কুলে কিংবা আড্ডায় একেকটা বই নিয়ে আমরা সবাই আলোচনা করতাম। অদ্ভুত রকমের ফ্যান্টাসি তৈরি হয়েছিল আমাদের জীবনে। আর সেই ফ্যান্টাসির জোরেই তো একটা সময় আমরা ৩ বন্ধ মিলে তিন গোয়েন্দার মতো একটা দলও খুলে।ফেলেছিলাম। কিন্তু কখনোই কোনো রহস্যের সমাধান করতে পারি নি।
রকিব হাসান, শামসুদ্দিন নওয়াব ও সেবা প্রকাশনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, আমাদের কিশোরকালটা এত সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়ার জন্য...