ভোর রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি। কখনো ঝুম আবার কখনো বা ঝিরঝিরি। ঘুম থেকে উঠেই অনলাইন পত্রিকায় দেখলাম সকাল থেকে বৃষ্টিতে ঢাকাবাসীর জীবনে দুর্ভোগ। শিরোনামটা কষ্টের। অথচ এরকম বৃষ্টিস্নাত একটা দিন সকলের কাছেই সুন্দর হওয়ার কথা। কিন্তু বিধি বাম! ঢাকার রাস্তাঘাট কিংবা ড্রেইনেজ সিস্টেমের যে বেহাল দশা, তাতে একটু বৃষ্টিতেই পুরো রাস্তা জুড়ে পানি জমে যায়। এইসব রাস্তায় চলাচল একদম অসম্ভব। ফলে শুরু হয় জ্যাম!
এমুহুর্তে আছি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও প্রধান রেল স্টেশন। এমন বিশাল রেলস্টেশন দেশের আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই রেলস্টেশনটি আজ এত বছর পর এসেও তার নিজস্ব জৌলুস ধরে রাখতে পেরেছে। ড্যানিয়েল বার্নহ্যাম এবং বব বুই নামক দুইজন মার্কিন স্থপতির নাম এত সুন্দর রেল স্টেশনের ডিজাইনের পেছনে জড়িয়ে আছে।
ছোট বেলায় টিভি নাটক কিংবা সিনেমায় ঢাকার দৃশ্য দেখানোর শুরুতেই এই কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনের অংশের দৃশ্য দেখানো হত। আরেকটা হল শাপলা চত্ত্বরের দৃশ্য। সারাজীবন টিভিতে এসব দেখে দেখে বড় হয়ে একটা সময় পর যখন প্রথমবারের মতো চোখের সামনে এই দুইটা স্থান দেখতে পেয়েছিলাম, সেদিনটার অনুভূতি ছিল সত্যিই অন্যরকম।
এই স্টেশনটি কমলাপুরে অবস্থিত বিধায় এর নাম কমলাপুর স্টেশন রাখা হয়েছে। পুর অর্থ তো কমবেশি আমরা সবাই জানি। নগর, গ্রাম, স্থান বা বাসস্থান। এজন্যই বাংলাদেশের বেশিরভাগ এলাকা বা অঞ্চলের নামের শেষে পুর সংযুক্ত থাকে৷ তবে কমলাপুরের নামকরনের পেছনের কোনো গল্প পাওয়া যায় না। কেউ কেউ বলে এই এলাকায় একসময় কমলা উৎপাদিত হত, আবার কেউ কেউ বলে কমলা নামের কেউ হয়তো এখানে কোনো একসময় ছিল। কিন্তু এগুলো সবই মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত গল্পকথা। এগুলোর পেছনে শক্ত কোনো ইতিহাস বা স্বাক্ষী পাওয়া যায় না।
ঝিরঝির বৃষ্টিতে কমলাপুর রেল স্টেশন প্লার্টফর্মে বসে ট্রেইন ছাড়ার অপেক্ষা করার ফাঁকে ফাঁকে কমলাপুর নামকরনের ইতিহাস খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অনলাইনে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এরূপ কোনো ইতিহাস বা তথ্য খুঁজে পেলাম না। এদিকে ট্রেইনের সময়ও চলে এসেছিল। তাই তখনকার মতো রণে ভঙ্গ দিয়ে কমলাপুরের ইতিহাস খুঁজা বাদ দিয়ে ট্রেইনে উঠে পড়েছিলাম।
আমার ট্রেইনের সময় ছিল দুপুর ৩ টা ২০ মিনিটে। গন্তব্যস্থল কসবা। একটু আগে ভাগেই চলে আসতে হয়েছিল স্টেশনে। কাল থেকে ঢাকার প্রতিটা রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। কোনো কোনো রাস্তার ১ কিলোমিটার পার হতেই অনেকের এক ঘন্টা পার হয়ে যাচ্ছিল। ভাবছিলাম আজও বুঝি সময় অনেক বেশি লাগতে পারে। কারণ গুগল ম্যাপে জ্যাম দেখাচ্ছিল।
কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো খুব অল্প সময়েই আমি কমলাপুর স্টেশনে পৌছে যেতে পেরেছি। রাস্তায় তেমন একটা জ্যাম পাই নি। যেহেতু প্রায় ২ ঘন্টা হাতে রেখে রওয়ানা দিয়েছিলাম, তাই স্টেশনে পৌছানোর পর আমার হাতে আরো দেড় ঘন্টার মতো সময় অবশিষ্ট ছিল। এতটা সময় স্টেশনে থেকে করবোটা কী? মানুষ আর ট্রেইন দেখা ছাড়া তো আর কিছু করার নেই এখানে। যদিও মানুষ দেখতে আমার খারাপ লাগে না।
বাংলাদেশের অন্যতম ব্যাস্ত একটা স্টেশন হল এই কমলাপুর রেল স্টেশন। সারাদিন জুড়ে একটার পর একটা ট্রেইন এই স্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছেড়ে যায়। আবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একটার পর একটা ট্রেইন এই স্টেশনে চলে আসে। একেকটা ট্রেইন প্লার্টফর্মে এসে থামে, আর সেখান থেকে পিঁপড়ার মতো মানুষ বের হয়ে আসে। মানুষের বিশাল লাইন। সবাই যে যার গন্তব্যে ফিরে এসেছে।
আজকের পরিবেশটা সুন্দর। হালকা বৃষ্টি, ঠান্ডা বাতাস, সবকিছু মিলিয়ে প্লার্টফর্মে বসে থাকতে খারাপ লাগছিল না। ইচ্ছে হচ্ছিল আরো কিছুক্ষণ থাকি। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমার ট্রেইনটা হুইসেল বাজিয়ে যাচ্ছে। আরেকটু পর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। তার সাথে রওয়ানা দিব আমিও। সব মায়া ছেড়ে শেষ মুহুর্তে উঠে পড়লাম ট্রেইনে। বাইরে তখনোও বৃষ্টি। ট্রেইনের জানলা দিয়ে সেই বৃষ্টির ঝাপটা একটু একটু করে মুখে পড়ছে। খারাপ লাগছে না...