১। ”ক্যারে ভাই, অনেক দিন পর আসলু, মাত্র এই কয়দিন থ্যাইকাই চলি যাবু, আবার কুনদিন আসপু”
২। “ক্যা বাহে সেদিনেই না আলু, আজকেই চলি যাবু, তোমরা বাহে নিজের গ্রামের মানুষ গুলাক ভুলি যাবার ন্যাগচ্ছেন আস্তে আস্তে, আচ্ছা যা, দেখি শুনি যাইস, আর ভালো হয়য়া চলাফেরা করিছ।”
৩। ”কি ব্যাহে জ্যাটো!, ঢাকাত যান, আমার প্রনয়ক একটু দেখেন, ওয় তো তোর মতো চালাক নোয়ায় ব্যাহে, উয়াহ একটু বোঝাইতো, যাতে চাকরী বাকরী করার চেষ্টা করে।”
৪। ”কিরে ভাই, যাবার নাগচ্ছিস, যা! সাবধানে যাইস, আর দেখিস তো তোর কোম্পানিত কোন লোক টোক নেয় নাকি। নিলে মোক একটু জানাইস, অনেকদিন থেকে বসি আসম, বা মাও খালি গাইল পারে, মোর আর ভালো নাগে নারে, তুই একটু চেষ্টা করিস ভাই, যদি কিছু কইর্যার পাইস।”

আমি শেষ যেদিন আমার আত্মার সম্পর্কের মানুষগুলোর কাছ থেকে দুরদেশে জীবিকার চাহিদায় যাত্রা করেছিলাম, সেই দিন আমার প্রানপ্রিয় পাড়ার কিছু মানুষের শেষ কথাগুলো আজো আমার কানে বাজে, তাদের প্রতিটি শব্দ আজও আমার হৃদয়ে এবং স্মৃতিতে স্পষ্টভাবে গেথে আছে। আপনি যদি ভেবে নেন আমি আমার ব্লগ লেখার জন্য কথাগুলো নিজের থেকে বানিয়ে লিখেছি, তাহলে আপনি ভুল করছেন। উপরের চারটি বাক্যের একটি শব্দ ও আমি নিজের থেকে বানিয়ে লেখছি না, কারন এই শব্দ গুলো বানিয়ে লেখার মতো প্রতিভা আমার মাঝে নাই। এই চারটি বাক্যের প্রতিটি শব্দের মাঝে যে ভালবাসা, যে আবেগ, যে অনুভূতি লুকিয়ে আছে, সেই ভালবাসা, আবেগ এবং অনুভূতি বোঝার মতো যোগ্যতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে হয়তোবা এখন অবধি দেন নাই। ধন্যবাদ @bdcommunity আমাকে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবার জন্য একটু সময় করে দেবার জন্য, ধন্যবাদ আপনাদের আমাকে আমার আত্মার সম্পর্কের মানুষগুলোকে চিনিয়ে দেবার জন্য।
আমি উত্তরবঙ্গের মানুষ ভাই, মফিজ টফিজ যাই ভাবেন না কেন, তাতে আমার কোন প্রকার সমস্যা নাই। আজ আমাকে কেউ মফিজ বললে, আমি কোন প্রকার রাগ করি না, বরংচ ভালোই লাগে, কারন এই মফিজদের মাঝে অসাধারন একটা গুন আছে, সেটা হলো তারা খুব সহজেই যে কোন মানুষকে আপন করে নিতে পারে, কারণ তারা খুব সহজেই যে কোন মানুষকে বিশ্বাস করে। আর তাদের এই সহজলভ্য বিশ্বাসের কারনেই আজ তারা মফিজ নামে পরিচিত। মফিজ এর কথা কেন বলছি আপনাদের জানেন তাদের কথা না বললে যে আমি আমার পাড়ার বর্ননা দিতে পারবো না আজকে ভাই।
যাই হোক ফিরে আসা যাক আমার পাড়া থেকে চলে আসার শেষ মহূর্তে। প্রথম বাক্যটি ছিল আমার পাড়ার এক দিদির, তার ভালো নাম উর্মি কিন্তু আমরা তাকে বেবী বলে ডাকি, আর আমি বেবী দিদি, কারন তিনি আমার থেকে বয়সে একটু বড়। ও একটা বিষয় আপনাদেরকে পরিষ্কার করি, তা হলো ভালো নাম আর ডাক নাম। ভালো নাম বলতে আমারা আমাদের স্কুলের সার্টিফিকেটে যে নাম প্রদান করি সেই নামকে বোঝায় এবং যে নামটা শুধু মাত্র সেই পরিবারের ব্যক্তিরা ছাড়া অন্যরা জানতে পারে না সেই নামটাই ভালো নাম। আর ডাক নাম বলতে যে নামটা পাড়ার সকল ব্যক্তি জানেন। যেমন একটা উদাহরন দেই, এই বেবী দিদির বাবার ডাক নাম হচ্ছে “বেদেশী”, সত্যি কথা বলতে কি উনি আমার জ্যাঠা মশাই কিন্তু আমি এখন অবধি উনার ভালো নামটা জানি না, কারন ওনি বিদেশী বলেই বেশী পরিচিত এবং আমরা ছোট বেলা থেকেই ওনাকে এই নামেই জেনে আসছি। আমার আরেক পাড়ত জ্যাঠা মশাই, যার ডাক নাম ”মাস্টার” যদিও তিনি কোন স্কুল বা কলেজ এর কোন শিক্ষক না। আমার পাড়ার আরেক জ্যাঠা মশাই যার ডাক নাম “ঠগড়া” যদিও বা তিনি কোন ঠকবাজ নন। আমার পাড়ার এক বড় ভাই, এবং পড়ার বড় ভাইদের আমরা দাদা বলে ডাকি, যার ডাক নাম বুলেট, ছোট বেলায় ও বুলেটের মতো দৌড়াতো তাই ওর নাম সবাই বুলেট রেখেছিলো। আমার নিজের ছোট বোন ছোট বেলা থেকেই খুব চিকন চাকন তাই সবাই ওকে ”শুটকি” বলে ডাকে, আমি নিজের কথাই কেন বা বাদ দেব, আমার পড়ার সবাই আমাকে আগে এবং এখনো মদন বলে ডাকে, তাই বলে কিন্তু আমি কোন কালেই মদন ছিলাম না, এই ডাক নামটা আমার ভালো নামের সামজ্ঞস্য শব্দ আমার ভালো নাম ”সাধন” তাই পড়ার আমি হয়ে গেছি ”মদন”। আমাদের পাড়ায় শুধু মাত্র একটা ব্যক্তিরেই কোন প্রকার ডাক নাম নাই, সেটা হলো আমার আপন চাচা, কারন উনি এমন একজন ব্যক্তি যার কোন প্রকার ডাক নাম খুজে পাই নাই আমারা পড়ার মানুষজন।
আমার শেষ শোনা বেবী দিদির বাক্যে ফিরে আসা যাক আবার, আপনার যদি উত্তর বঙ্গ বিশেষ করে বংপুর বিভাগের ভাষা সম্পর্কে কোন প্রকার অভিজ্ঞতা থেকে থাকে তাহলে হয়ত “ক্যারে ভাই” শব্দটার গভীরতা বুঝতে পারবেন। এই শব্দটা যে কোন মানুষকে তার হৃদয়ের খুব গভীর থেকে উচ্চারন করতে হবে অন্যথায় এই কথাটি খুবই বিদঘুটে শোনাবে আপনার কাছে, বিশ্বাস না হয় চেষ্টা করে দেখতে পারেন, আপনার আপন কোন ছোট ভাইয়ের উপরে এবং অল্প পরিচিত কোন ছোট ভাইয়ের উপরে তফাৎটা ঠিক বুঝতে পারবেন। আমার পড়ার শুধু বেবী দিদি না, সকল দিদিই আমাকে খুব ভালোবাসে এবং স্নেহ করে। তাদের বন্ধু সূলভ আচরন, বাস্তব জীবনের লড়াই করে বেচে থাকার মতো পরামর্শ এই পৃথিবীতে আমাকে আর কেউ কখনো দিতে পারবে কিনা জানি না। আমার পড়ার সকল ভাই বোনেরা আমার রক্তের সম্পর্কের চেয়েও অনেক বেশি কিছু দাবি রাখে। এই সম্পর্কের নাম আমি আত্মার সম্পর্ক দিলাম।
দ্বিতীয় বাক্যটি আমার পাড়ার এক জ্যাঠা মশাইয়ের। ওনার ডাক নাম নব্বই। নব্বই কেন তার ডাক নাম এই রহস্য আমি আজো জানতে পারি নাই। তবে একটা বিষয় আমি খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারি দারিদ্রতা ওনাকে সত্যিকারের একজন মানুষ বানিয়েছেন। তাই হয়তো উনি বাস্তবতাকে জীবনের সাথে খুব বেশি আলোকপাত করার চেষ্টা করেন। দারিদ্রতা হয়তো কিছুটা ওনার পিছন ছেড়েছেন সন্তানদের পরিশ্রমের ফলে। কিন্তু আবেগ এবং বাস্তবতা ওনাকে এমন এক চরিত্র দান করেছেন যেটা আমাদের পাড়ার আর কারো মাঝেই আমি খুজে পাই না। ভাই আমি আগেই বলে নিয়েছি আমি মফিজ এলাকার লোক। এ থেকেই হয়তো বুঝতে পারছেন আমাদের এলাকার মানুষের আর্থিক অবস্থার কথা। তবে আমার পড়ার অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত। তাই হয়তো আমার পাড়ার কোন পরিবার না খেয়ে থাকলে অন্য পাড়ার লোক ভূলেও জানতে পারেন না। কারন শিক্ষার গুন আমার পাড়ার মানুষকে দারিদ্রতার উপরে কতৃত্ব করার অসীম এক ক্ষমতা প্রদান করেছেন। হিন্দু পাড়া, পাড়াটা ঠিক তেমন বড় না মাত্র সাতটি পরিবারের সমন্বয়ে আমাদের ছোট্ট সেই পাড়া। আশে পাশের অধিকাংশ পরিবারগুলোই মুসলিম। কিন্তু আমারা হিন্দু মুসলিম এমন ভাবে মিশে গিয়েছি যে, বাহিরের কোন ব্যক্তি আমাদের মাঝে পার্থক্য খুজে বের করতে পারবেন না অতি সহজে। ভাতৃত্ত্ববোধ আমার পাড়ার মানুষগুলোর এক অনন্য গুন। যা বরাবরেই আমার মাঝে চরিত্রে প্রকাশিত এবং এই গুনেই আমি আজ পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারি।
তৃতীয় বাক্যটিও আমার পাড়ার এক জ্যাঠা মশাইয়ের, এক গর্বিত পিতা এবং একজন অসুরনযোগ্য ব্যক্তিত্ব। শিক্ষিত হয়েও কৃষিকে নিজের পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন যাতে নিজের শিক্ষার আলো বাংলার কৃষিতে প্রয়োগ করতে পারেন এবং সমাজের বাকি কৃষকদের খুব কাছে থেকে সাহায্য করতে পারেন। এমন পিতার সন্তানরা ভালো কিছু করবে এটাই স্বাভাবিক। যমজ সন্তানের পিতা তিনি। বড় সন্তান জগনাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাকত্তোর পাশ করে সরকারি চাকুরির চেষ্ঠায় আছেন। আর ছোট ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপে আমেরিকার কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করছেন। যদিও বা ওরা দুজন আমার জ্যাঠাতো ভাই, তার চেয়ে একটা ভালো সম্পর্ক রয়েছে আমাদের মাঝে, আমারা তিনজন খুবই ভালো বন্ধু। আমি ওদের দুজনের জন্য খুবই গর্ববোধ করি, যে আমি ওদের পাড়ার একজন। জ্যাঠা মশাইয়ের বড় ছেলে ঢাকায় থাকেন, আমি যতবারেই বাড়িতে যাই, আসার সময় জ্যাঠা মশাই আমাকে উক্ত কথাটি বলতে কখনো ভোলেন না। নিজের সন্তান এবং পরিবারের জন্য ভালোবাসা আমার পড়ার প্রতিটি পরিবারের মধ্যে খুবই দৃশ্যমান। তাই হয়তোবা এখনো আমার পাড়ার প্রতিটি পরিবার এখন অবধি ছাপান্নবর্তী পরিবারেই আছে।
শেষ বাক্যটি আমার এক দাদার, যে কিনা ডিগ্রী পাশ করে বিভিন্নভাবে বিভিন্নরকম চাকুরীরর চেষ্ঠা করে ব্যর্থ। তার মনপুর্ত চাকুরী সে এখন অবধি খুজে পায় নাই। সত্যি কথা বলতে কি, আমার এই দাদাটাই একমাত্র আমাদের পাড়াটাকে, আমাদের গ্রামটাকে খুব বেশী ভালোবাসে। সে আমাদের পাড়া ছেড়ে অন্য কোথায় ঠিক বেশি দিন থাকতে পারে না। এই সত্যটা আমি এবং আমার জমন দুই জ্যাঠাতো ভাই দুজন জানে। তাই সে কিছুদিন চাকুরী করে সেই চাকুরী ছেড়ে আবার গ্রামে চলে যান। এবার আমি সূভাগ্যক্রমে তার সাক্ষাৎ পাই। আমি এটাও জানি আমি যদি তার জন্য কোন চাকুরীর ব্যবস্থা করি, সে হয়তোবা চাকুরীতে যোগদান করবে কিন্তু বেশীদিন চাকুরী করবে না সে। ফিরে যাবে তার চিরচেনা পাড়ায়। তাই আমি গ্রামের বাড়িতে গেলে ফিরে আসার সময় সকল লোকের সামনে সেই এই কথাগুলো বলে। যাতে সকলে বিশ্বাস করে ও কিছু না কিছু করা চেষ্ঠা করছে।
আমাদের ছোট্ট এই পাড়ার পরিচয় এখন অবধি আপনাদের দেয়া হলো না। কেমন বোকা আমি। আবেগের বশে কতগুলো কথা বলে ফেললাম এখন অবধি পাড়াটা কোথায় অবস্থিত সেটাই বললাম না। বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার, সুন্দরগঞ্জ থানার অন্তর্গত বৃহত্তম জরমনদী গ্রামের দক্ষিন জরমনদীতে আমাদের পাড়াটি অবস্থিত। নদীর তীরবর্তী এলাকা হবার কারনে তেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নেই আমাদের পাড়াতে। তবে আমার কাছে আমার পাড়ার প্রতিটি স্থান অতুলনীয়। কারন সেই পাড়াতেই আমার জন্ম হয়েছে এবং আমি আমার শেষ নিশ্বাস আমার পাড়াতেই ত্যাগ করতে চাই।
ভালো মানুষ, খারাপ মানুষ দুই প্রকৃতির মানুষেই হয়তোবা আমার পাড়ায় আছে কিন্তু পাড়ার প্রতিটি মানুষের সাথেই আমার যে আত্মিক সম্পর্ক সেই সম্পর্কের কাছে ভালো খারাপের ব্যবধান করাটা আমার কাছে খুবই কঠিন কাজ। জীবনে কখনো করতেও পারি নাই এবং করার চেষ্টাও করি নাই। চারটি বাক্য দিয়েই নিজের পাড়ার সমস্ত মানুষগুলোর বর্ণনা দেবার চেষ্টা করলাম। ভালো লাগা খারাপ লাগা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত। কিন্তু আমার পাড়ার প্রতি আমার অগাধ ভালবাসা চিরকাল আমার সঙ্গী।
ভালো থাকবেন সকলেই। ধন্যবাদ...