জনজীবনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার মহতী উদ্দেশ্যে শহরের রাস্তায় যখন গণপরিবহনের চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়, মনের ভিতর আজানা এক আতঙ্ক এসে সজোরে আঘাত করেছিল। ভেবেছিলাম এবার বুঝি আর নিস্তার নেই। করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে হয়তোবা আর পালিয়ে বাঁচতে পারব না। অপরদিকে দৈনিক অফিসে যাতায়াত বাবদ চারশত টাকা খরচ, খুব ভালো ভাবেই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ফেলে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। যাক এবার বুঝি যাতায়াত খরচ অনেকটাই কমবে। কিন্তু বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে গনপরিবহনে যাতায়াত খুবই ঝুকিপূর্ণ সরুপ। তাই আরও কিছুদিন নিজের সচেতনতার পক্ষপাদিত্ব করে আমার দৈনিক আয়ের চল্লিশ শতাংশ অফিসে আসা যাওয়ার পথে ব্যয় করতে থাকলাম। মাসিক বেতনের ৬০% যেদিন হাতে পেলাম, সেদিন পকেটে যথেষ্ট পরিমান টাকা থাকার পরেও দুইশত টাকা খরচ করে আর বাসায় ফেরার সাহস পেলাম না।
বেতনের চল্লিশ শতাংশতো আমি যাতায়াত বাবদ খরচ করেই ফেলেছি। নিজের হাতখরচ বাবদ দশ শতাংশ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বাবদ তিন শতাংশ, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ডাটা এবং টকটাইমের জন্য পাঁচ শতাংশ। অবশিষ্ট থাকল মাত্র দুই শতাংশ। তাই অটোরিকশা যোগে বাসায় আসার আর সাহস পেলাম না। যে ব্যক্তি সকাল বেলায় গনপরিবহনের বিপক্ষে অবস্থান করে অটোরিক্সা অর্থাৎ সিঙ্গেল পরিবহনের পক্ষে জোড়ালোভাবে অবস্থান করে অফিসে এসেছিলেন, তার বর্তমান অবস্থা এখন তাকে বাধ্য করছে বিপক্ষ দলে যোগদান করতে।
পক্ষ এবং বিপক্ষ কি অসাধারন এক সমীকরন তাই না। অটোরিকশা যাকে আমি সিঙ্গেল পরিবহন বলে আখ্যায়িত করলাম, করোনা ভাইরাসের মহামারীর আতঙ্ক কিছু সময়ের জন্য আমাকে আমার বাস্তবতার বিপক্ষে অবস্থান করিয়ে দেয়। আমাদের সমাজের আর দশজন মানুষ যে বাস্তবতার পক্ষে অবস্থান করছে আমারও উচিত ছিল, তাদের পক্ষেই অবস্থান করি। আমার উচিত ছিল যে দিন থেকে শহরের রাজপথে গনপরিবহন চলাচল শুরু করে সেদিন থেকেই সেটাকে ব্যবহার করা।
তাহলে সত্যি কি আমি ভূল ছিলাম? আমার পক্ষ বাছাই সঠিক ছিল না? না আমি কোন ভাবেই ভূল ছিলাম না এবং আমাদের সমাজের বাকি দশজন ব্যক্তিও ভূল ছিল না। আমাদের বাস্তব বর্তমান আমাদের জীবন ব্যবস্থাকে যে দিকে আকর্ষণ করে, আমাদের মন এবং মস্তিষ্ক ঠিক তার বিপরীত দিকে অবস্থান করে। অর্থাৎ উক্ত পরিস্থতিতে আমাদের সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি চাচ্ছিলেন গনপরিবহন পরিহার করার জন্য। কিন্তু তাদের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি তাদেরকে বাধ্য করেছে গনপরিবহনকে সম্মতি প্রদান করতে।
তাই বলে কি আপনি আমাদের দেশ ও সমাজের মানুষকে দ্বিধান্বিত মানুষ বলে আখ্যায়িত করবেন, এটা মোটেই সঠিক বিষয় না। বিবেক,বাস্তবতা এবং ক্রিয়ার সামগ্রিক সমীকরন আমাদের মানসিক "নিরপেক্ষতা"।
নিরপেক্ষতার সমীকরন আমাদের স্বাভাবিক জীবনে, একটি মিশ্রিত ক্রিয়ার ফলাফল। আজ আমরা সমগ্রজাতি নিরপেক্ষ মানসিকতার অধিকারী। আমরা ঠিক অন্যায়কারীর পক্ষেও নেই এবং ভালো মানুষগুলো আমাদের থেকে সুরক্ষিত দুরত্ব বজায় রেখে চলেন। আমরা যেমন আন্যায়কারী এবং অন্যায় দুটোকেই প্রশয় দেই, অপরদিকে ভালোমানুষ সেজে সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি। আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া কোন বিধানের যেমন তীব্র থেকে তীব্রতর সমালোচনা করতে আমরা যেমন কোন প্রকার ত্রুটি করি না। ঠিক সেই বিধানকে সাদরে গ্রহন করতে আমরা দ্বিধান্বিত হই না। তাইতো আমরা শংকর জাতি এবং সমগ্র পৃথিবীর বুকে প্রকৃষ্ট নিরপেক্ষ জাতি।
আমাদের নিরপেক্ষতার এই সমীকরন আমাদের সমাজে সুখ, সমৃদ্ধির যোগান দিতে পেরেছে কিনা তা আমি চিন্তা করে দেখি নাই। কিন্তু আমি খুব বড় গলায় বলতে পারি, এই সমীকরন পৃথিবীর বুকে আমাদেরকে খুব ধৈর্য্যশীল একটি জাতি হিসাবে অধিষ্ঠিত করেছে। আমাদের এই নিরপেক্ষ মানসিকতার জন্য আজ আমাদের দেশে অন্যায়ভাবে শোষনকারী রাঘববোয়ালদের অভাব নেই। তারা রক্তচোষা জোকের মত যুগের পর যুগ ধরে আমাদের রক্ত চুষে যাচ্ছেন। আমরা তাদের অন্যায় অত্যাচারকে প্রশয় দেই কারন তারা অসীম ক্ষমতার অধিকারী বনে গেছেন, তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের কাছে আমরা এবং আমাদের বিবেক বড়ই অসহায়। তাই আমরা তাদের এড়িয়ে চলে নিরপেক্ষ থাকার অভিনয় করতে করতে আজ বাস্তবেই আমরা নিরপেক্ষ।