নীলার পরিবার ইন্দোনেশিয়া থেকে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই ১৯৮৩ সালের মে মাসে শ্রীলংকার রাজধানীতে সহিংসতা শুরু হয়েছিল। জুলাই মাস কে সেখানে ব্ল্যাক জুলাই নামে ডাকা হয়। কারণ ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কায় তামিল পরিধি দাঙ্গার জন্য ব্যবহৃত হয় এই নামটি। এই দাঙ্গার মাধ্যমে ৪০০ থেকে ৩০০০ জন মানুষের প্রাণ হারিয়েছিল। তামিল সিংহলি দের দ্বারা আক্রমণ করেছিল সেখানে এবং তাদের বাড়িঘর , যানবাহন ইত্যাদি সবকিছুতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ।
একটা সময় শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। তখনকার সময় ছিল প্রায় ২৩ থেকে ২৪ জুলাই ১৯৮৩ এর মধ্য রাতে। তখন শোনা গেছে 13 জন শ্রীলংকার সৈন্য নিহত হয়েছিল। শ্রীলংকার কাছে এটি ছিল সবথেকে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যেটা ইতিহাসের পাতায় তাদের এখনও ভয় দেখায়। সিংহলী জনতা তামিলদের জাতি ধ্বংস করার জন্য তাদের খুজছিল। কলম্বোর সিংহলি দাঙ্গাবাজরা তামিল সম্প্রদায়ের উপর সুনির্দিষ্ট আক্রমণ করার জন্য, তাদের জাতিগোষ্ঠীর বাড়ির ঠিকানা এবং সম্বলিত ভোটার তালিকা ব্যবহার করা শুরু করে একটা সময়।
নীলার পরিবার তামিল ছিল এবং সে দেশে তারা নতুন হিসেবে প্রবেশ করে। সেখানে গিয়ে তার বড় মেয়ে সুষমাকে একটি স্কুলে ভর্তি করে । নীলার স্বামী একটি টেক্সটাইল মিলের জেনারেল ম্যানেজার এর কাজে নিযুক্ত ছিলেন। সেই দাঙ্গার সময় নীলা ঘরেই ছিল। সে চেষ্টা করতে থাকে তার সন্তান এবং তার স্বামীর সাথে যোগাযোগ করার।
কিন্তু সেই সময় ফোনগুলো মারা গিয়েছিল। তাই নীলা প্রধান রাস্তার দিকে দৌড়ে যায় এবং দেখতে পায় তখন কতটা ভয়াবহ খারাপ অবস্থা । তখন যেন শহরটা ছিল জলন্ত আগুন । ঠিক তখনই নীলা দেখতে পেল স্কুলের ভ্যানটি তার মেয়েকে নিয়ে আসছে এবং তার গলির দিকে যাচ্ছে । এটা তার কাছে এসে থামল কিন্তু শুধু সেখানে তার বড় মেয়ে সুষমা ছিল।
নীলা লোককে জিজ্ঞেস করলো "সৌম্য কোথায়?" তখন চালক বলল "তার স্কুলের গেট বন্ধ ছিল,", এবং চলে গেল।
নীলা সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শান্ত ছিল, তাকে দেখতে বিভ্রান্ত এবং বিচলিত লাগছিল। নীলার আশেপাশের প্রতিবেশীরা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তাঁর এইসব কিছু দেখল এবং একজন লম্বা লোক নীলার দিকে এগিয়ে আসলো। লোকটির নাম ছিল ডক্টর বিক্রমাসিংহে। তিনি নীলাকে বললেন, আপনার ছোট মেয়েকে আমাকে আনতে দেন । আমি সিংহলি, তার জন্য কেউ আমাকে আক্রমন করবে না । তারা শুধু তামিলদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।
নীলা কখনো এর আগে ডঃ বিক্রমাসিংহেকে দেখেনি এবং তার সাথে কখনো পরিচয় হয়নি। নীলা যে প্রতিবেশীর সাথে বন্ধুত্ব করেছিল তারা কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। তারা তখন তাদের আসল পরিচয় নিশ্চিত করে। অসহায় নীলা তিনি তাঁকে তাঁর ছোট মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য অনুমতি দেয়।
নীলা কাঁদতে কাঁদতে তার বড় মেয়ে সুষমাকে নিয়ে ঘরে ফিরে গেলেন। তার ছোট মেয়ে এবং স্বামীর নিরাপত্তার জন্য সে প্রার্থনা করতে শুরু করে। সময় টেনে নিয়ে যেতে লাগল এবং ঘন্টা দুয়েক পর , নীলা দেখতে পেল তার ছোট মেয়েটি ডাক্তারের হাত শক্ত করে ধরে তার বাড়ির দিকে আসছে। ডাক্তার নীলাকে বলছিল প্রথমে তার ছোট মেয়েটি তার সাথে আসতে অস্বীকার করে। কারণ হিসেবে সে বলেছিল সে তাকে চিনতে পারে না। কিন্তু স্কুলের শিক্ষক তাকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। তখনই চোখের পলকে ছোট মেয়েকে কোন কিছু না ভেবে তার হাত ধরে বাড়ির পথে রওনা করে।
কয়েক ঘন্টার মধ্যেই নীলার স্বামীও নিজের ঘরে ফিরে এসেছিলেন। দুইজন পুরুষ, একজন মুসলিম , একজন সিংহলি, উভয় মিলে সহকর্মী তাকে নিয়ে যান। তখন নীলা সে ডক্টরের পরিবারের কথা আরো ভালোভাবে জানতে পারে। নীলা চিন্তা করে সেই লোকটির কাছে তারা একেবারেই অচেনা ছিল। তার পরেও তার পরিবারকে সেই লোকটি সাহায্য করে।
কিছুদিন পরেই নীলার ছোট মেয়েটির প্রিয় মামা হয়ে যায় ডক্টর এর বিক্রমাসিংহে। তারপর থেকেই তাঁদের দুই পরিবার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। নীলা সেই পরিবারের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে , তাদের এই উদ্যোগ এবং সদয় অঙ্গভঙ্গি সে কখনো ভুলবে না। সে তার কাছে চিরঋণী।
-শেষ-