আমাদের বাড়ি থেকে মামাদের বাড়ি দেড় কিলোমিটার দূর।এখানে বিদ্যুৎ এসেছে দুবছর হলো।আমাদের বাড়ি যেমন গাছগাছালীতে ভরা,ছায়া-শ্যামল,মামাদের বাড়ি ছিলো তার বিপরীত।বাড়িতে তেমন কোনো গাছ ছিলো না।পূর্বপাশে একটি ঘর,মাঝখানে বড় এক উঠান আর পশ্চিমপাশে আরেকটি ঘর।উত্তর ও দক্ষিণ পাশে রান্নাঘর,গোয়ালঘর,মুরগির ঘর ইত্যাদি।মামাদের বাড়ির উঠান বড় বলে অনেকে বলে উঠানত নয় যেনো ফুটবল খেলার মাঠ।ভাইবোন যখন ছোট ছিলাম আম্মা তখন আমাদের নিয়ে একমাসের মধ্যে পনের দিন আমাদের বাড়িতে থাকতো বাকি পনের দিন নানুরবাড়ি।
গরমকালে মামাদের বাড়িতে প্রচন্ড গরম।বিদ্যুৎ ছিলো না তাই ঘরের ভিতর বৈদ্যুতিক পাখা না থাকায় বেশি গরম লাগতো।রাতের বেলা ঘরের বাহিরের আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে।তাই বড়মামিআম্মা উঠোনে বড় মাদুর পেতে দিতেন,আমরা সব ভাইবোনেরা এখানে শুতাম, পাশে আম্মা,মামিআম্মাও শুতেন।আর বড়মামা শুতেন টুলের উপর।মামাদের বাড়িতে ছয়-সাত ফুট লম্বা টুল থাকে বসার জন্য।উঠোনে শুয়ে আম্মা না হয় মামিআম্মা কিসসা বা গল্প বলতেন।গল্পগুলো হতো অনেকটা ভূতের।তাহলে আজ সেই গল্পগুলো থেকে একটা গল্প বলা যাক।এগুলো গল্প হলেও আসলে কথিত সত্য ঘটনা।
মামার বাড়ি থেকে দশ বিঘা দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় একটা বড় জঙ্গল।স্থানীয়রা এটাকে ঈমানী মার উজার বলে।দিনেরবেলা স্বাভাবিক থাকলেও রাতের বেলা নাকি জেগে উঠে জ্বিন-ভূত।ওরা হাতি-ঘোড়ার রুপ নিয়ে হাটে,মুখ দিয়ে আগুন বের করে,বিভিন্ন ধরনের ভয়ংকর আওয়াজ করে।মামাদের বাড়ি থেকে পশ্চিমে একটা ধানের ক্ষেত আছে,সেটা থেকে ফিরতে হলে ঈমানি মার উজারের পাশ দিয়ে ফিরতে হয়।একদিন মামাদের পাশের বাড়ির একজনের নাকি ক্ষেত থেকে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিলো।ওনি যখন আসছিলো,তখন হঠাৎ সামনে দেখে একটা সাদা ঘোড়া,আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে তারপর হঠাৎ মিলিয়ে গেলো।এটা দেখে বাড়িতে আসার পর জ্বর আসে এবং পরের দিন মারা যায়।
এরকম অনেক ঘটনা।এগুলো শুনে ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম আমরা।মাঝে মাঝে শিলুক বলা হতো,শিলুক মানে ধাঁধা।ধাঁধাতে দুইদল,আমরা সবাই মিলে একদল আর মামা একা একদল।আচ্ছা আজ আপনাদের জন্য একটা ধাঁধা দেয়,"ডালভরা সুপুরি,গুনতে লাগে বেপারি" বলেনতো দেখি এটা কি হবে?
আমরা সবাই মিলে একদল হলেও মামা জিতে যেতেন সবসময়।চাঁদনি রাতে শুরু হতো চাঁদ নিয়ে যুদ্ধ।ছোট বেলায় মনে হতো চাঁদ বুঝি আমার সাথে চলে,আমি চুপচাপ শুয়ে থাকলে চাঁদ নড়ে না,আমি পাশ ফিরলে চাঁদও বুঝি সরে যায়।আমি যেদিকে যায় চাঁদও সেদিকে যায়।খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আমরা এসব চিন্তা করতাম।
বিশেষ করে আমার মামাতো ভাই মারুফ,সে রেগে গিয়ে হুলস্থুল বাধিয়ে দিতো চাঁদ শুধু ওর।ঝগড়া যখন চরম পর্যায়ে তখনি মামা বলে উঠতো চাঁদ দেখা পর্ব শেষ এবার চলে আয় এখানে।
আমরা সবাই মামার কাছে যেতাম,তখন মামা বলতো এই যে আমি শুয়ে আছি,তোরা সবাই মিলে আমাকে উঠাবি,যদি উঠাতে পারিস তাহলে আমি প্রত্যেককে দু টাকা করে দিবো।তখনি আমরা সবাই মিলে টানাটানি শুরু করে দিতাম।কেউ মাথায়,কেউ হাতে, কেউ ধরে ধাক্কাধাক্কি,টানাটানি কোনো লাভ নেই।এক ইঞ্চি পরিমাণও সরাতে পারতাম না আমরা।মামা ছিলেন ছয়ফুট লম্বা মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান মানুষ।আবার তিনি তখন শরীরের ভর ছেড়ে দিতেন,আমাদের পক্ষে কি সম্ভব এই শরীর উঠানো!যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে যেতাম,তখন মামা নিজে নিজে উঠে যেতেন আর বলতেন,তোরা জিতে গেছিস,সকালে টাকা পেয়ে যাবি,এখন আর কোনো কথা হবেনা চুপচাপ শুয়ে ক্রমান্বয়ে বাতাস কর পাখা দিয়ে।এপাশ থেকে শুরু হবে পাখা দিয়ে বাতাস করা,একজনকে পঞ্চাশবার করে পাখা ঘুরাতে হবে।
আমার মামাতো ভাই যাকে আমরা দাদা বলি সে সবার বড়,সে যে পাশে শুবে তার বিপরীত পাশ থেকে পাখা দিয়ে বাতাস করা শুরু হবে।ও বড় বলে ওর উপর কথা বলা যাবে না।প্রথম জন পঞ্চাশ বার এভাবে দ্বিতীয়,তৃতীয় করে যেতে যেতে সবাই ঘুমিয়ে পড়তাম।রাত যখন বারোটা-একটা বেজে যেতো তখন আম্মা-বড়মামিআম্মা মিলে আমাদেরকে কোলে করে নিয়ে ঘরে শুইয়ে দিতেন।সকালে উঠে দেখতাম আমরা সবাই ঘরে ঘুমচ্ছি।
যখন চাঁদনি শেষ হতো,তখন খুব অন্ধকার থাকতো।তখনও কিন্তু আমরা উঠোনে শুয়ে তারা দেখতাম,তখন চাঁদ না থাকলেও তারা ঠিকই থাকতো।অন্ধকার রাতের তারা ভরা রাতের আকাশের রুপ বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই।আমরা তারার মাঝে মানব আকৃতি খুঁজতাম।
অনেকগুলো তারা মিলে মানুষের মতো আকৃতি রাতের অন্ধকার আকাশে খুঁজে পাওয়া যায়,যাকে আদমসুরাত বলে।এই আদমসুরাত কে আগে খুঁজে পায়,যে আগে খুঁজে পাবে সে রাতের লিডারশীপ পাবে।সে সব সময় দাদাই পেতো।কারণ দাদা আগে খুঁজে বের করে,তারপর প্রতিযোগিতা শুরু করতেন।কারণ তিনি কখনও লিডারশীপ হাতছাড়া করতেন না,মানব আকৃতি পাওয়ার পর দাদা আমাদের আকাশ ভাগ করে দিতেন তারা গণনার জন্য।একশোটা তারা গুণতে হবে এটাই কাজ।যেদিন মামা উপজেলা সদর থেকে অনেক রাতে ফিরতেন,সেদিন মামিআম্মা মাদুর পেতে দিলেও আমরা শুতাম না।সেদিন সবাই মিলে লুকোচুরি খেলতাম।
লুকোচুরি খেলা শেষকরে কাঁচের বোতল নিয়ে চলে যেতাম স্কুলের মাঠে।মামাদের বাড়ি রাস্তার পশ্চিমপাশে আর পূর্বপাশে স্কুল।স্কুলের ওখানে গিয়ে জোনাকি পোকা ধরতাম,সেটাকে আমরা বলতাম জিনি পোকা।এসব করতে করতে যখন সাইকেলের বেল শুনতাম,আমরা বুঝে যেতাম মামা এসেছেন সবাই গিয়ে মাদুরে শুয়ে যেতাম।মাঝে মাঝে অন্যকেউ আসলেও আমরা মামাভেবে শুয়ে যেতাম।পরে দেখতাম মামা আসেনি।তখন নিজেরাই বোকা বনে যেতাম।
কতোইনা ভালো ছিলো সেইদিন গুলি।আর এখন তারাবিহীন আকাশের অধিকারী কৃত্রিম আলোয় উদ্ভাসিত যান্ত্রিক শহরের আশ্রিত আমি।যেখানে বড় বেমানান আমি যেন কোন কালকুঠুরিতে বন্দী।
