খুব ছোট বেলা থেকেই কবুতর পালার প্রতি একটা বাসনা মনের মধ্যে ছিল, মহল্লার বড় ভাইয়েরা যখন কবুতর আকাশে উড়াত তখন প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে কবুতর এর দল বেধে উড়া উড়ি দেখতাম। তখন ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেন এ পড়ি বাবা একদিন বাজার থেকে ২ টা কবুতর কিনে এনেছিল। সেই কবুতর ৫দিন পর্যন্ত আর জবেহ করতে দেইনি কান্না কাটি করে। ষষ্ঠ তম দিনে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি আমার সেই কবুতর দুট নেই রান্না হয়ে গেছে।দুই দিন প্রচুর কান্না কাটি করেছিলাম।
একটু বড় হওয়ার পর এক ঈদ এর সমস্ত সালামি আর জমানো সব টাকা দিয়ে জিঞ্জিরা হাট থেকে দুই জোড়া গিরিবাজ কবুতর কিনে এনেছিলাম সেই থেকে আমার কবুতর পালা শুরু।
এখন আসি মুল কথায় হে ফেন্সি কবুতর এর উথান – ফেন্সি কবুতর বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই পালার প্রচলন ছিল কিন্তু ২০১২ এর পর থেকে ব্যাপক হারে তা বৃদ্ধি পায়। প্রথম দিকে ফ্যানটেল/লাক্ষা, কিং, হোমার এইসব ফেন্সি কবুতর বাংলাদেশে বেশি প্রচলন ছিল।পরে অবশ্য অনেক জাতের কবুতর আমাদের দেশে আসে সেই সম্পর্কে পরে বলছি।
প্রথম দিকে কবুতর নিছক শখের বশে মানুষ পালাশুরু করলেও পরে আর সেটা শুধু সখের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, যখন দেখল একজোড়া ফেন্সি কবুতর এর নিউ পর (নতুন পালক উঠার আগের সময়) এর বাচ্চা ১০০০ টাকা থেকে ২০০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায় (জাত ভেদে)। মানুষ হুমড়ি খেয়ে পরল এই অতি উৎসাহী ব্যবসার উপর, একজোড়া ভাল জাতের বাচ্চা এর জন্য তখন হাহাকার অবস্থা মানুষ টাকা অগ্রিম দিয়ে আসত বাচ্চা এর জন্য। আর ডিম, বাচ্চা দিচ্ছে এমন কবুতর তো তখন সোনার হরিণ।
মানুষ ধার দেনা করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এমন কী জমি জমা বিক্রি করে কবুতর এর খামার দেয়া শুরু করে দেয়, আর এই সুযোগটিই কাজে লাগায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, তারা বিদেশ থেকে হরেক জাতের নতুন নতুন কবুতর দেশে আনতে শুরু করে যার দাম আকাশ ছোঁয়া ৩০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ পর্যন্ত থাকে, তার পর ও মানুষ সর্বস্ব দিয়ে সেই কবুতর কিনতে থাকে বাচ্চা হলে বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে সেই আশায়।
এই একি আশা করে অফিস সহকর্মী এর পরামর্শ মতে ২০১৪ এর শেষের দিকে শখ করে পালা গিরিবাজ কবুতর এর সাথে আমিও শুরু করি শখের ব্যবসা (যা এখন বুঝতে পারি শখ এবং ব্যবসা এক নয়)
ব্যাংক থেকে ২,০০,০০০ টাকা ঋণ এবং জমানো টাকা দিয়ে সাভার এর এক বড় ভাই এর পুর খামার কিনে নিয়ে আসি, সেই খামারে তখন ছিল ফ্যানটেল/লাক্ষা, কিং, হোমার, বুখারা, সিরাজী উল্লেখযোগ্য আর হে সাথে কিছু বাজ্রিগার পাখিও ছিল।
খুব ভালই যাচ্ছিল কবুতর এর ব্যবসা প্রতিমাসে প্রায় ৭০/৮০ হাজার টাকার বাচ্চা বিক্রি করতাম ঢাকার বাহিরেও কবুতর পাঠাতাম বক্স এর মধ্যে করে আহ! সুখ আর সুখ, টাকা আর টাকা।
আমার খামারের কিছু কবুতর এর ছবি দেয়া হলো যা এখন শুধুই স্মৃতি-
লংফেইজ
জ্যাকোবিন
ক্যাপচীন
বুখারা
শর্ট ফেইস কালো
শর্ট ফেইস হলুদ
আউল
কিন্তু সুখ খুব বেশিদিন আমাদের কপালে স্থায়ী হলো না ২০১৬ এর শুরুর দিকে আমদানিকারকেরা যেন পাগল হয়ে গেল। ঝাকে ঝাকে কবুতর আমদানি করা শুরু করল ঢাকা এবং চিটাগং এর দুই আমদানিকারক (নাম বল্লাম না, নাম বল্লে চাকরি থাকবেনা ), আমদানিকারক দের আমদানি করা ট্যাগ লাগানো, রিং পরানো কবুতর রেখে আমাদের কবুতর কেন মানুষ কিনবে? এমন অবস্থা তখন ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি। তার পর যা হবার তাই হল, কবুতর এর দাম গেল রসাতলে।আমি যেই পলিশ আউল ৮০,০০০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম সেই কবুতর শেষে ৭,০০০ টাকায় বিক্রি করেছিলাম।
পলিশ আউল
আমাদের এক বড় ভাই KF Sohel Rabbi (ফেন্সি কবুতর এর ডাক্তার নামে সবাই চিনে) অনেক আগেই এই ভবিষ্যত বাণী করে ছিলেন যে- এক সময় আসবে মানুষ ঝাকায় করে ফেন্সি কবুতর বিক্রি করবে।পরবর্তীতে সেটাই হয়ে ছিল।
KF Sohel Rabbi ভাই আমার খামারে (মাঝে)
আমার মত যারা ধার দেনা করে কবুতর এর খামার দিয়ে ছিলেন প্রায় তারা পথে বসে গিয়ে ছিলেন।অনেক খামারি এর সাথে আমার পরিচয় ছিল সবার সাথেই কথা হয়েছিল সবারই একি অবস্থা, বেশির ভাগ খামারিই তাদের খামার বিক্রি করে দিয়ে ছিল।
এখন ২০২১ সাল, ফেইসবুক এর কল্ল্যাণে আবার জানতে পারছি ফেন্সি কবুতর এর দাম নাকি আবার বাড়ছে অনেকেই নতুন করে খামার দিচ্ছে। আবার হয়ত কবুতর এর দাম বাড়বে একজোড়া জ্যাকবিন/পলিশ আওল ৮০,০০০ টাকায় বিক্রয় হবে এবং সেই টাকা দিয়েই অনেক তরুন খামারি তাদের সর্বস্ব দিয়ে কিনবে, আর তার ফায়দা নিবে কিছু অসাধু লোক।