কাক ডাকা ভোর। চোখ ভরা ঘুম। এ যেন গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত আমি। হঠাৎ মাথার কাছে ফোন বেজে উঠলো। ঘুমের মধ্যেই ফোনের রিংটন শুনছি। হয়তো দুই একবার কেটেও দিয়েছিলাম। প্রচন্ড বিরক্তিবোধ করে ঘুমের মধ্যেই ফোন রিসিভ করলাম।
ফোনের ঐ পাশ হতে যা শুনতে পেলাম তাতে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। এক লাফে বিছানা থেকে উঠে দৌড় দিলাম। আশে পাশে কোথাও দেখাদেখি নাই শীতের ভোর কন কনে শীত ও কুয়াশা চললাম প্রায় ১.৫ কিলো পথ। যেতে যেতে সকাল ৭ টা বেজে গেলে। দিনাজপুর হতে সৈয়দপুরের প্রবেশ মুখ। সারা দেশের সাথে যোগাযোগের জন্য শুধু দিনাজপুর নয় ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড় এর একমাত্র রুট এটি। যাই হোক দূর হতে দেখতে পাচ্ছি ব্রিজের পাশেই লোকজনের ভীর। লোকজনের ভীর দেখে হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলাম। অবশেষে একে একে লোকজনের ভীর ঠেলে সামনে গিয়ে যা দেখলাম। তাতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। চোখের কোনায় অজান্তে জল চলে এসেছিল। ভাইয়ের নিথর দেহটি এভাবেই নদীর ধারে পরে থাকবে কে জানতো? এই তো গত রাতেই ভাইয়ের সাথে রাতে আড্ডা দিলাম। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলো আর তো হবে না ভাইয়ের সাথে আড্ডা। রাত বিরাতে খোলা আকাশের নিচে শুনা হবে না ওনার গান। সারাদিনের গ্রীষ্মের প্রখর রোদের তাপে ক্লান্ত শরীরে কার গান শুনে ক্লান্তি দূর হবে। কে শুনাবে মান্না দের সেই বিখ্যাত গান "কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই।" কার শুরের মূর্ছনার উত্তপ্ত প্রকৃতি ঠান্ডা হবে? কার শুরের তালে খোলা আকাশের নিচে রাত বিরাতের আড্ডা গুলো মেতে উঠবে? দুবা ঘাসে বসে থাকা আড্ডা গুলো কাকে বিরক্ত করবে? রাতের আড্ডায় কার সাথে রাজনৈতিক তর্ক বিতর্ক হবে? এতো সব প্রশ্ন ভাবতে ভাবতে দিন শেষে রাত হল এভাবেই দশটি বছর পার হয়ে গেলো।
আড্ডার কথা উঠলেই ভাইয়ের কথা মনে পরে। মান্না দের কফি হাউজটা যেমন ঠিকেই আছে শুধু ময়নুলরা নেই ঠিক আমাদের খোলা আকাশ, খোলা আকাশের নিচে মাঠ, সেই জোস্না রাত, সেই রাতের ঝি ঝি পোকার শব্দ সবেই আছে শুধু নেই সেই রিপন ভাই। ভাইয়ের চলে যাওয়ার সাথে সাথে আড্ডাটিই ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে গেছে, পরিবর্তন হয়ে গেছে আড্ডার ধরন।
এখন আর বন্ধু হৃদয়ের হৃদয়ে জায়গা নেওয়া হলুদ বাড়িতে নতুন ভাড়ায় আসা ইয়াসমিন মেয়েটার জন্য রাতের আধারে গলা ফাটিয়ে ভাঙ্গা গলায় গাওয়া হয় না "ইয়াসমিন ভালোবাসা কারে কয়?"
এখন আর আড্ডা শেষে রাতের আধারে আম, কাঁঠাল, ডাব চুড়ি করে খাওয়া হয় না। এই আড্ডা গুলোও এখন ভার্চুয়াল হয়ে গেছে। আড্ডার স্বাদ ও তৃপ্তিও কমে গেছে। মেসেঞ্জারের ভিডিও কল কি আর সেই আড্ডার স্বাদ দিতে পারে?
এখনো সুযোগ পেলে সেই আড্ডায় বসা হয়। কিন্তু সবাই তো আর সময় দিতেও পারে না। এখন আড্ডায় আর গান গাওয়া হয় না। এখন জীবনের পাওয়া না পাওয়া সফলতা ব্যর্থতা গুলো আড্ডায় মূল আলোচ্য বিষয়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে।
এখন আর আম কাঁঠাল ডাব চুরি করে ভাগের অংশ হিসেব করা হয় না। এখন জীবনের সুখ আর দুঃখের হিসেব নিকেস করতেই যেন শেষ।
এখনো আড্ডা হয় কিন্তু সেই রাতের আড্ডা গুলো হয় না। এখন আরমান ভাইয়ের চায়ের কাপে চুমুকে চুমুকে রাজনৈতিক তর্ক বিতর্ক হয় আড্ডায়। আড্ডার সমাপ্তি হয় কোন এক পক্ষ টেবিল থাপরিয়ে চলে গেলে। আবার পরের দিন।
আগের আড্ডা গুলো ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আপলোডের প্রতিযোগিতা ছিল না। প্রতিটি মুহুর্ত হৃদয়ের অংশ হয়ে যেত। আগের আড্ডা গুলো ফেসবুকে আর্চিভ করে বার করতে হয় না। সব স্মৃতি হৃদয়ে আছে একাকিত্ব অনুভব হলে সেই স্মৃতি চোখে ভাষে। সেই স্মৃতি গুলোই তো একমাত্র সাথী হয়ে থাকে।
আড্ডা আর আড্ডা
সৈয়দপুর শহরে এমন কোন জায়গা আছে যেখানে দেই নিই আড্ডা?
পাঁচ মাথা মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা চুমুকে চুমুকে আড্ডা, থেমে থাকে নিই বাস টার্মিনালের ভিতরে আড্ডা। রাতে নিয়ন বাতির নিচে ক্যান্ট পাবলিকের সামনে আড্ডা, বিমানবন্দর রোডের সাজুর পান খেতে খেতে আড্ডা। গরমের উত্তাপের রাবেয়ার ব্রিজের পাশে নদীর ধারে বসে আড্ডা। স্টেশনের মাসুমের হোটেলের পুরি খাওয়ার আড্ডা। এই তো লক ডাউনের আগের রাতেই মাসুমের হোটেলে বসে এক গাদা আলু পুড়ি খেয়ে নিলাম আড্ডা দিতে দিতে মালাই চা এর শেষ চুমুকে আড্ডার সমাপ্তি ঘটালাম। হয়তো সেই আড্ডাটিই হতে পারে আমাদের শেষ আড্ডা। হয়তো আর বলা হবে না "মাসুম জালদি ছে লেকে আও গারমা গারাম পুড়ি (আলু পুড়ি), জালদি ছে মালাই মারকে চা দো" (আমাদের সৈয়দপুরে উর্দূভাষী বিহারীর সংখ্যা অনেক বেশি)।
তবে বেস্ট আড্ডা তো সেটাই ছিল যেই আড্ডার রিপন ভাই ছিল। যে আড্ডাতে লেংটা কালের বন্ধুদের সাথে রাত বিরাতে দাপিয়ে বেরাতাম।
যে আড্ডা গুলোতে ফুটবল বিশ্বকাপের প্রেডিকশন নিয়ে মাতিয়ে তুলতাম। যে আড্ডা গুলোতে ফুটবল বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিল আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে সব সময় থাকতো টান টান উত্তেজনা। ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় পুরো আড্ডা জুরে থাকতো ক্রিকেট আর ক্রিকেট। ভারত আর পাকিস্থানের সমর্থকদের মধ্যে থাকতো টান টান উত্তেজনা। এখন এইসব আড্ডা হয়ে গেছে ভার্চুয়াল। ফেসবুকে দখল করে নিয়েছে এই আড্ডার মাঠ গুলো। তর্ক বিতর্ক গুলো হয়ে গেছে বিভিন্ন গ্রুপে। বন্ধুদের খ্যাপানো হয় ফেসবুকে ট্রল করে।
সেই আড্ডায় তো কত ধরনের শয়তানি বুদ্ধি চলে। একবার আড্ডা দিতে দিতে আম চুরির প্লান করলাম। আম চুরি করবো বলে বন্ধু হৃদয়ের কাছে আম পারানোর একটা বাঁশ নিলাম। আমরা স্থানীয় ভষায় বলি কোঠা। অন্য জায়গায় কি বলে জানি না। সেটা দিয়ে খুব সহজেই আম পারা যায় শব্দও কম হয়। সেদিন বন্ধু হৃদয় বাসায় ছিল। রাত তখন ১ টা। বন্ধু হৃদয়ের বাসায় কিন্তু আম গাছ আছে। ঠিক শয়তানি মাথায় বুদ্ধি আসলো আজ না হয় হৃদয়ের বাঁশ দিয়ে ওকেই বাঁশটা দেওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। ওর গাছের আম সাবার করে দিয়ে ভদ্র ছেলেদের মত ওকে বাঁশটা বুঝায় দিলাম সাথে কয়টা আম ও। আসলে চুরিটা তো হালাল করতে হবে। আম পেয়ে মহা খুশি। পরে সেই আম খেতে খেতে আড্ডা আপনারাই বলুন সেই আড্ডাটা কেমন আড্ডা হতে পারে? পরের দিন যা হবার হল বাকিটা আর না বলি।
এক বার তো আমরা ৬ জনের মত হোটেলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। খাওয়ার সময় ইচ্ছামত খাচ্ছিলাম। গরুর পা এর নেহরী পরাটা। শীতকালে এর থেকে ভালো নাস্তা আর কি হতে পারে। সবাই ইচ্ছা মত খাইলো। কিন্তু বিল আর কেউ দিবে না। তাই সবাই এক এক করে খাইলাম আর এক এক করে উঠে চলে আসলাম। সব থেকে বেশি খাদুক আয় চিপায় বসা ছেলেটা কোন দিকে দেখা দেখি না করে ইচ্ছামত খেলো। আমরা তো বার হয়ে আসে দূর থেকে লক্ষ করতেছি সে কি করে। বিল দেওয়ার মত তো সে ছেলে না। সে খাওয়া শেষে ক্যাশের কাছে গেলো টিস্যু নিল সেখান থেকে খিলল নিলো নিয়ে সেও চিল মুডে চলে আসলো😃। ভাবটা এমন ছিল যে সে বিল দিয়েই বার হবে 😛। তবে সব সময় সেখানে আড্ডা দেওয়া হয় তাই পরে বিলটি দেওয়া হয়েছিল।
আরেকটা কাহিনী বলি একটু অশ্লীল শব্দের ব্যবহার হয়েছে। এক বন্ধুর নিক নাম দিয়েছিলাম সবাই মিলে পুন্দি (পশ্চাতদেশ)। তো একদিন হঠাৎ একজন বলে বসালো পুন্দি সমার্থক শব্দ যে সব থেকে বেশি বলতে বলবে তাকে ট্রিট দিবে। মামুন সাথে সাথেই পুন্দি, পাছিলা, পাছা, পুটকি, পুকটি, গোয়া, হোগা, গাড়, দোকান, শাটার এভাবে এক বারেই ১৫ -১৬ টির মত সমার্থক শব্দ বললো। কারো চান্স নেই সে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেলো। সবাই থ হয়ে রইলাম। আমাদের আড্ডায় যে অশ্লীলতা ছিল না এমনটা নয় তবে নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সব কিছু প্রকাশ করাও উচিত নয়। থাক না কিছু গোপন আড্ডা। অশ্লীলতা থাকলেও বেয়াদবী ছিল না। আমাদের মধ্যে কেউ নেশাখোর ছিল না। তবে দুই একজনের সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাকলেও তারা সাইডে গিয়ে লুকায় খেত (আমাদের এলাকায় জুনিয়র থেকে সিনিয়র এমনকি বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রকাশ্যে সিগারেট খেত না এখনো খায় না।) এমন শত শত মজাদার এডভাঞ্চার রোমাঞ্চকর স্মৃতি রয়েছে যা এখনো ভাবলে হৃদয়ের খুদা মেটায়।
সত্যি কথা বলতে কলেজে বা ভার্সিটিতে বন্ধু বান্ধুবীর সাথে আড্ডা দেওয়া হয় নিই। পারিবারিক অর্থনৈতিক টানা পরানের কারণে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরেই নিজেকে কর্মের সাথে জড়িয়ে ফেলি তাই কলেজ ভার্সিটির আড্ডা কি জিনিস জানি না। তবে খেলাধুলা প্রেমী আমি। খেলাধুলা খুবই পছন্দ করি। আমাদের অনেক পুরাতন সরকারী রেজিঃ করা ক্লাব আছে। সৈয়দপুরে যুদ্ধকালীন সময়ে প্রথম জাতীয় পতাকা তৈরী ও উত্তোলন করেন শহীদ কুদরত এলাহী। ওনার নাম অনুসারেই ক্লাবের নাম "শহীদ কুদরত স্মৃতি সংসদ"। কুদরত এলাহী ছিলেন ভলিবল খেলোয়ার। ক্লাবের প্রধাণ খেলা হচ্ছে ভলিবল। এছাড়া ক্যারাম, দাবা, টেবিল টেনিস খেলা আমার পছন্দ। বিভিন্ন জায়গায় ভলিবল টুর্নামেন্ট গুলো খেলতে গিয়ে যা আড্ডা হত সেই সব আড্ডা নিয়ে বলতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে।
আড্ডার কথা কি বলে শেষ করা সম্ভব? না সম্ভব না। আড্ডা প্রিয় মানুষ আমি। আড্ডার শেষ নেই। জীবন যতদিন আছে আড্ডা থাকবে। আড্ডা কি আর লিখে শেষ করা যায়?
আড্ডা
মাহাবুব আলম (@steemitwork)
আড্ডা!
সে তো সকাল বিকাল সন্ধ্যা
আড্ডা!
সে তো সুযোগ পেলেই জমানোর ধান্দা।
আড্ডা!
সে তো হাজারো স্মৃতি
আড্ডা!
সে তো বন্ধুদের চিল্লা চেচামেচি
আড্ডা!
সে তো চায়ের কাপের লিগার
আড্ডা!
সে তো আড় চোখে তাকানো কারো ফিগার।
আড্ডা!
সে তো মুড়ি চানাচুর তেল পেঁয়াজ মরিচ এর মাখামাখি
আড্ডা!
সে তো তর্কে বিতর্কের সাথে হাতাহাতি
আড্ডা!
সে তো বন্ধুদের এক সুতোয় গাঁথা
আড্ডা!
সে তো বন্ধুর আবদার আর চাওয়া পাওয়া।
আড্ডা !
সে তো প্রেমের ছন্দ
আড্ডা!
সে তো কখনো ভালো কখনো মন্দ
আড্ডা!
সে তো কখনো কবিতা
আড্ডা!
সে তো অসমাপ্ত গল্প।।
জি আড্ডার সমাপ্তি নেই। চলবে আড্ডা, দৈনন্দিন জীবনে আড্ডা, কাজে কর্মের ফাঁকে আড্ডা, বিডি কমিউনিটিতে আড্ডা, ডিসকোর্ডে আড্ডা।।