আমরা প্রায়ই জিডি এর ব্যাপারে শুনে থাকি। জিডি-থানা-পুলিশ এসব শুনলেই অনেকের মাঝেই একটা ভয় কাজ করে। জিডি কী এবং কেনো-কীভাবে করা হয় সেই বিষয়ে কী আমাদের সবার স্পষ্ট ধারণা নেই। এই লিখাটা পড়লে আপনি জেনে যাবেন জিডি কী, কেন-কখন-কীভাবে-কোথায় করা হয়। জিডির তদন্ত, গুরুত্ব, আইনের দৃষ্টিতে এর গুরুত্ব। মোট কথা জিডির আদ্যোপান্ত আমরা এই লিখা থেকেই জানতে পারবো।
জিডি কী?
GD-Genaral Diary হলো কোনো বিষয়ের সাধারণ বিবরণ। এটিকে অপরাধ ও অন্যান্য সংবাদ বিষয়ক রেজিস্টার বলা যেতে পারে। প্রতিটি পুলিশ থানা ও ফাঁড়িতে একটি সাধারণ ডায়েরি থাকে, জিডি থানার এই বিশেষ বইয়ে লিপিবদ্ধ করতে হয়। । প্রতিদিন সকাল ৮টায় শুরু করে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার সংবাদ রেকর্ড করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো ব্যক্তি থানায় এটি করতে পারবেন। জিডি একটি অপরাধ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।
কোনো কারণে যদি কোনো ব্যক্তি বা সম্পত্তির ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে বলে আশংকা হয়, বা কোনো জিনিস হারানো গেলে তাহলে, সেই বিষয়টি সম্পর্কে থানায় অবিহিত করে আইনিভাবে লিপিবদ্ধ করাকে জিডি বলে। কোনো নির্দিষ্ট থানার অন্তর্ভুক্ত জনগণ, বা কোনো ঘটনার কেন্দ্রাস্থলে ঐ এলাকায় ঘটে যাওয়া বা ঘটতে যাচ্ছে এমন সব ঘটনা সম্পর্কে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জিডি করতে পারেন। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে (CODE OF CRIMINAL PROCEDURE, 1898) জিডি সম্পর্কে বলা হয়েছে।
কেন জিডি করা প্রয়োজন?
বিভিন্ন কারণে জিডি করা প্রয়োজন হয়। ভবিষ্যত সুরক্ষার জন্য জিডি করা হয়। কোনো ঘটনা সম্পর্কে আইন বা পুলিশকে অবগত করতে জিডি করা দরকার। কোনো ঘটনা যার প্রেক্ষিতে মামলা করা যায় না, বা কোন ব্যাক্তি বা সম্পত্তির নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভয়-আশংকা থাকলে জিডি করা প্রয়োজন। আবার গুরুত্বপূর্ণ কাগজাদি হারিয়ে গেলে জিডি করা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র, চেকবই বা গুরুত্বপূর্ণ দলিল হারিয়ে গেলে বা হারানো জিনিস খুঁজে পেতে জিডি করে পরে জিডির কপিসহ জিডির নাম্বার দরকার হতে পারে।
আইনগত সাহায্য পেতে জিডির বিকল্প নেই। একটি জিডিকে কেন্দ্র করে একটি মামলা শুরু হতে পারে। কোনো অপরাধের আশংকা থাকলে, জিডি করার পর সেই অপরাধ সংগঠিত হলে কোর্টে সেই জিডি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই জিডি করার পর জিডির কপি ও জিডির নাম্বারটি নিজের সংগ্রহে রাখতে হবে।
কোনসব বিষয়ে জিডি করবেন এবং তাতে কী লাভ হবে?
কোনো ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাউকে ভয়-ভীতি দেখানো হলে বা কেউ নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে।
কোন অপরাধ সংঘটনের আশঙ্কা থাকলে।
কারো সম্পদের ক্ষতি হলে বা হুমকি দিলে।
কোনো কারণে যদি কেউ আপনার উপর হামলা করতে পারে বলে মনে হয় এবং আপনি যদি জিডি করে রাখেন তাহলে সেরকম কোনো ঘটনার পর দোষী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে জিডি কাজে আসে।
কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনার প্রেক্ষিতে জিডি করে রাখলে, পুলিশ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন, নিরাপত্তার অভাববোধ করলে পুলিশ নিরাপত্তা দিতে পারে।
কেউ হারিয়ে গেলে, নিখোঁজ হলে, বা পালিয়ে গেলে (গৃহকর্মী, দারোয়ান বা নৈশপ্রহরী পালিয়ে যাওয়া)।
কোনো প্রয়োজনীয় কাগজাদি বা জিনিসপত্র হারিয়ে গেলে। যেমনঃ শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পরিচয়পত্র, অন্যান্য দরকারি নথি, পাসপোর্ট, চেকবই, লাইসেন্স, মূল্যবান রশিদ, স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ, গুরুত্বপূর্ণ কোন সার্টিফিকেট, এটিএম বা ক্রেডিট কাড, মোবাইল ফোনের সিম, জমির দলিল ইত্যাদি।
আইনি সহায়তা পেতে জিডি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধ সংগঠনের পর সাক্ষ্য হিসাবে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র খুঁজে পেতে বা হারানো কাগজ তুলতে গেলে জিডির কপি ও নাম্বারসহ কর্তৃপক্ষরে কাছে আবেদনের ক্ষেত্রে, নতুন-পুরোনো ভাড়াটে সংক্রান্ত তথ্য, প্রবাসীদের কোনো সমস্যা, বখাটে-মাদকসেবীদের তথ্য প্রদানে জিডি এর ভূমিকা অপরিসীম।
কোথায় এবং কীভাবে জিডি করবেন?
যে এলাকায় ঘটনা ঘটেছে বা ঘটবে বলে আশংকা সেই এলাকাতেই জিডি করা উচিৎ। এক্ষেত্রে নিজের এলাকাকেই প্রাধান্য দেয়া উচিৎ, নাহলে পরে আইনি সাহায্য পেতে বেগ পেতে হতে পারে। নিজের নাম, ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য সহকারে সংশ্লিষ্ট থানার নাম উল্লেখ করে ঐ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অফিসার ইনচার্জ) বরাবর দরখাস্ত আকারে আবেদন করতে হয়।একটি সাদা কাগজে সাধারণ দরখাস্তের মতই জিডি করতে হয়। যে বিষয়ে জিডি করা হবে তার উল্লেখ করতে হয়। বিবরণ অংশে যে বিষয়ে জিডি করবেন তার বিবরণ দিতে হয়। যদি কেউ আপনাকে হুমকি দেয়, তাহলে হুমকি দাতার নাম, দেয়ার কারণ লিখতে হবে। কিংবা কোনো কিছু হারানো গেলে, হারিয়ে যাবার স্থান, হারানো জিনিস/ব্যক্তির বিবরণ, সম্ভব হলে হারানো জিনিস/ব্যক্তির নমুনা ছবি আকারে জিডির সাথে সংযুক্ত করে দিতে হবে। সব শেষে নিচে আপনার নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখতে হবে।
আপনাদের সুবিধার্থে নিচে জিডির একটি নমুনা দেয়া থাকবে।
জিডি করতে কত টাকা লাগে, কে সহায়তা করে?
জিডি করতে কোনো টাকা লাগে না। এটি আপনার একটি অধিকার।
আপনি (অভিযোগকারী) নিজে জিডি লিখতে পারেন। প্রয়োজনে থানার কর্মকর্তাও জিডি লিখে দিতে পারেন। থানার সার্ভিস ডেলিভারী অফিসারের কাছে পরামর্শ চাইতে পারেন। নিজে জিডি না লিখতে পারলে তাকে অনুরোধ করা যেতে পারে, তবে এক্ষেত্রে কোন টাকা দেয়ার দরকার নেই।
আপনার জিডি কে নথিভুক্ত করবে?
থানার ডিউটি অফিসার জিডি লিপিবদ্ধ করেন। তিনি ডায়েরীতে জিডির নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। এক্ষেত্রে দুটি কপি করে, একটি থানায় সংরক্ষণ করা হয়। অন্যটিতে জিডির নাম্বার লিখে যথাযথ সাক্ষর ও সীলমোহর দেয়া হয়। যার ফলে অবৈধ পক্রিয়ায় কিংবা পূর্বের তারিখ দেখিয়ে কেউ জিডি করতে পারেন না। আবেদনকারীর কপি যত্নসহকারে সংরক্ষণ করতে হবে।
জিডি রেকর্ড করার পর ডিউটি অফিসার একটি কপি অফিসার ইনচার্জ এর নিকট পাঠাবেন। জিডিটি যদি আমলযোগ্য অপরাধ (cognizable offence) বিষয়ক হয় তাহলে থানা কতৃপক্ষ বিষয়টি সাথেসাথে আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন, ও আবেদনকারীকে জানাবেন যে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
অনলাইনে জিডি
থানায় যেতে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে, বা যেসব ক্ষেত্রে তৎক্ষণাত পুলিশকে না জানালেও হয়, যেমনঃ পাসপোর্ট হারানো, এসব ক্ষেত্রে অনলাইনে জিডি করা যেতে পারে। অনলাইনে জিডি করতে হলে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের ওয়েবসাইট http://www.dpm.gov.bd-এ প্রবেশ করলে Citizen Help Request নামে একটি লিংক পাওয়া যাবে। লিঙ্কটিতে গিয়ে সকল পূরণ করে সাবমিট করলে সংশ্লিষ্ট থানায় আপনার তথ্যগুলো পৌঁছে যাবে। আপনি মোবাইলে জিডির নাম্বার পেয়ে যাবেন, সেটি সংরক্ষন করে রাখবেন। আপনি চাইলে সরাসরি ইমেইল করতে পারেন, ইমেইলেই আপনাকে জিডি নাম্বার দিয়ে দেয়া হবে। ইমেইল করার ঠিকানা: bangladesh@police.gov.com ফ্যাক্স: ৯৫৫৮৮১৮।
জিডির নমুনা কপি
তারিখ: ..................
বরাবর
অফিসার ইনচার্জ
গেন্ডারিয়া থানা, ঢাকা।
বিষয় : সাধারণ ডায়েরী প্রসঙ্গে।
জনাব,
যথাবিহিত সম্মানপূর্বক নিবেদন এই যে, আমি নিম্ন স্বাক্ষরকারী: জামিলুর রেজা চৌধুরী বয়স : .৪৫ বছর, পিতা/স্বামী : করিমুল রেজা চৌধুরী, মাতা: আহমেদা বেগম। পোস্ট অফিস: গেন্ডারিয়া থানা: গেন্ডারিয়া জেলা: ঢাকা। বর্তমান ঠিকানা: পোস্ট অফিস: গেন্ডারিয়া, থানা: গেন্ডারিয়া, জেলা: ঢাকা।
এই মর্মে জানাচ্ছি যে আজ/গত ফেব্রুয়ারী ৩০ তারিখ দুপুর ৪টা ২০ মিনিটে গেন্ডারিয়া হাইস্কুল এর সামনে থেকে আমার নিুবর্ণিত কাগজ/মালামাল হারিয়ে গেছে।
বর্ণনা : (যা হারিয়েছে)
বিষয়টি থানায় অবগতির জন্য সাধারণ ডায়েরিভুক্ত করার অনুরোধ করছি।
নিবেদক,
(আবেদনকারীর স্বাক্ষর)
জামিলুর রেজা চৌধুরী :
ঠিকানা :
ফোন নম্বর :
আশাকরি আপনারা জিডি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো পেয়ে গেছেন। এই লিখাটি অনুসরণ করে আপনি জিডি করতে পারবেন। কোনো সমস্যা থাকলে থানায় গিয়ে পুলিশের সাহায্য নিয়ে জিডি করার সুযোগতো থাকছেই। কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে বা মন্তব্য থাকলে জানাতে পারেন। আজ এ পর্যন্তই।