আর তিন ঘন্টা পরেই ভুপেনের ব্যালিস্টিক্স এর ওপর প্রেজেন্টেশণ। আয়নার সামনে দাড়িয়ে সমানে নিজের মন্দভাগ্যকে অভিশাপ দিতে দিতে শার্ট ইন করছে সে। কাগজে কলমে দুবছর কমিয়ে এখন তার বয়স বাইশ, কিন্তু কৈশোরকালের মেদই এখনো কাটিয়ে উঠা হয়ে উঠলো না। ভুড়ির চাপে দু একটা বোতাম যেকোন মূহুর্তে বুলেটের মত ছিটকে যেতে পারে। আর সে আশঙ্কায় দম আটকে রেখে চাপ কমাতে গিয়ে প্রায় হাপানি উঠে যাবার অবস্থা হয়ে যাচ্ছে।
পাশেই নির্মেদ এথলেটিক বন্ধু মামুনের ফরমাল গেটাপে হ্যান্ডসাম সেজে থাকা দেখে আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে গেটের দিকে হাটা দিল ভূপেন। আর দেরি করলে সোয়া আটের বাস ও মিস হয়ে যাবে।
ভূপেনের এই ছোট্ট দুনিয়াতে নারী সান্নিধ্যের বরই অভাব। নারি সান্ন্যিধ্য নয় ঠিক, কারন ক্লাসের পড়া আর গাজার লোভে ছুটে আসা বিপরীত লিঙ্গ থেকে গুটিকয়েক প্রেমের প্রস্তাব ও আছে তার হালখাতায়। তার দরকার আসল নারী সান্নিধ্য। এমন কাউকে যে তাকে বুঝতে পারে। তার মেকি এস্ট্রোফিজিক্সের গল্প, রাত তিনটের সময় জীবন নিয়ে আলাপ, এসব চাহিদা বুঝতে পারবে এমন কাউকে। কিন্তু পথের কাটা এই “বাবু মেদ” মনে হয় তাকে সর্বসান্তই করে ফেলবে।
“আট কারা?” “গ্রূপ আট? সামনে আসুন আপনারা।“
সুপন স্যারের আকস্মিক ডাকে হতচকিত ভুপেন কি করবে বুঝতে না পেরে দাড়িয়ে জোরে বলে বসে, “প্রেজেন্ট স্যার!”। ক্লাসের সামগ্রিক হাসির তোপে ভুপেনের মনে হচ্ছিল সে কেদেই ফেলবে। বাচ্চাকালের এই দুটোই দুঃস্বপ্ন তার। নেংটো ক্লাস করতে চলে আসা আর ক্লাসের মাঝখানে কেদে ফেলা। কতবার যে এই স্বপ্ন দেখে চীৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠে গেছে ভুপেন, তার কোন ইয়ত্তা নেই।
কিন্তু, অস্বাভাবিক ভাবে খুবই ভাল প্রেজেন্টশান হয়ে গেল তার। খানিক আগের কিংকর্তব্যবিমূর অবস্থার কথা ভুলে গিয়ে রাইফেলের ব্যরেল গ্রুভিং এর উপর খুবই চিত্তাকর্ষক একটি লেকচার দিয়ে ফেলল সে। কারন, তার ঠিক সামনের বেঞ্চেই যে স্বয়ং আফ্রোদিতি বসে আছে।
বাইরে বেরিয়ে বয়েজ ক্লাবের আড্ডার আজকের হট টপিক ভুপেন। আমে্রিকা গট ট্যলেন্ট বিজেতা টাইপের একটা ফিল নিয়ে মার্লবোরোর ধোয়া ছাড়তে ছাড়তেই হটাৎ কাধের উপর কে যেন আলতো টোকা দিলো। অভ্যাস বসত সিগেরেট হাতের তালুতে লুকিয়ে ছ্যাক খেতে খেতে পিছেনে ঘুরে তাজ্জব বনে গেল ভূপেন, জমদুতের মত দিতি দাঁড়িয়ে। আফ্রোদিতির সংক্ষেপ দিতি।
“প্রেজেন্টাশান খুবই ভালো হয়েছে, আর সিগেরে্টটা পারলে ছেড়ে দিও।“
শুধু এই বলেই তটস্থ হরিনির মত পা ফেলে ভুপেনকে কনফিউশানে রেখে চলে গেল সে।
নীলক্ষেতের এত জনবহুল রোডে হেটে যেতে যেতেও একা বোধ হচ্ছিল ভুপেনের এখন, মনে হচ্ছে, বিধাতার কোন এক প্রাংক এর শিকার সে।
দুবছর পরের কথা। মাঝখানে হাই হ্যালো ছাড়া কোন বাস্তব আলাপচারিতা হয় নি আর তাদের মাঝখানে। এখন আর ভুপেন নারী সান্নিধ্য মানেই শুধু প্রেম মনে করেনা। পালটে যাওয়া জীবনধরনের সাথে তাল মিলিয়ে ভুপেনের কাছে এখন সবকিছুর উর্ধে বন্ধুত্য। মানবিক বন্ধুত্য, যার একটি নাম দিয়ে পরিণতি দিতে হবে, এধারনা তার কাছে এখন বিলুপ্ত।
সেইন্টমার্টিন্সে ব্যাচ ট্রিপে গিয়ে তার এধারনা আরো পাকাপোক্ত হয়ে গেল। কারন, মানবিক সততার কাছে বাহ্যিক বেশভূষার কোন মুল্য নেই। কি সুন্দর করে সবার সাথে গান গাইছে সে, তাল দিতে দিতে পা নাচাচ্ছে আর বাকি সবার সাথে চোখাচোখি হবার সময় ও দেখতে পাচ্ছে যে, সবাই খুশি। এ পাপমুক্ত আনন্দ বিলগেটস থেকে শুরু করে সব চেয়ে গরিব মানুষটির জন্যেও যে সমান ভাবে উন্মুক্ত।
“টোয়েন্টি নাইন!! আমিও খেলতে চাই, আমাকেও নাও না?”
এই ঘ্যানঘ্যনে সুরে হাতের তাস থেকে মনোযোগ ছুটে গেল ভুপেনের। মাত্রই ঠিক করেছিল যে তুরুপের রানী দিয়ে এই দান টা না মেরে দিলে হ্যান্ডটা ছুটে যাবে, এমন সময় আসল রানীর আগমন। আফ্রোদিতি যে তাস খেলতে পারে, এ ব্যাপারটা আচ ও করতে পারেনি সে। পরপর দুদান দিতির কাছে হেরে ইস্তফা দিয়ে তবেই বুঝতে পারলো যে সের এর উপর সোয়া সের ছাড়া সোয়া সেরনি ও হতে পারে।
“আজকে কি অবস্থা?”
“জ্বর টর আসছিলো আর?”
“ও বাই দ্যা ওয়ে কি করো?”
“আমার টুং টুং এ বিরক্ত হচ্ছ না তো?”
পরপর মেসেঞ্জারের নোটিফিকেশণ গুলো এখন আর বিরক্ত হয় না ভুপেন। জীবনের গল্প বলার জন্যে সম্পর্কের নাম খুজতে যাওয়ার বাহুল্যতা থেকে মুক্তিই তার কাছে এখন মনে হয় স্বাধীনতা। নিজের অসুস্থ থাকার পরও সুস্থথাকার বার্তার টুং টুং অপার পাশে পাঠিয়ে দিয়ে ভুপেন চিন্তা করে, এইতো জীবন। এইতো বেচে থাকা।