২৪ বছর বয়স ভূপেনের, কিন্তু জীবন কেন যেন উলটেপালটে একাকার হয়ে আছে। ইদানীং রাত তিনটের সময় প্রায়শই দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গে তার। সটান উঠে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানার পাশের টেবিলে রাখা বড় পানি ভর্তি মগ সে এক ঢোকে সাবাড় করে ফেলে, কিন্তু তৃষ্ণা কখনো মেটে না। কারন এ তৃষ্ণা তো পানির নয়, জীবনের।
লেখক হতে চাওয়া এই ছেলেটির লেখায় অলংকার, ভঙ্গিমা কিছুই নেই। তবুও লিখে যাওয়া কখনো বন্ধ হয় না। আর, কিভাবে যেন তার এই দুর্বল সাহিত্যের কিছু পাঠক ও জোগাড় হয়ে গেছে। পড়ে, না পড়ে তারা বাহবা দিয়ে যায় আর সেই বাহবা কুড়িয়ে সে দুর্বল থেকে দুর্বলতর সাহিত্য কর্ম লিখে যায়।
যারা ভূপেনের দুটির বেশি লেখা পড়েছে, তারা জানে যে, এর সাহিত্যে পটভুমি হিসেবে মৃত বোন ও রাত তিনটের উল্লেখ থাকবেই। সাথে নায়ক হবে স্ট্রাগলিং প্রেমে ব্যর্থ লেখক। অনেকটা যেন সস্তাদরের অটোবায়োগ্রাফি। এই চিরায়ত গল্পের মুল্য যে শুন্যের ও নিচে, তা সে ভালো করেই জানে। তবুও লেখা বন্ধ হবে না, কারণ, এ যে তারই জীবনের উপন্যাস।
বাঙ্গাল ছেলে, আর আট দশটি বাঙ্গালির মত যথেষ্ট তামাটে বর্নের। ভাইকিংদের মত দেখতে প্রকান্ড চেহারার অবয়ব, সাথে ওজনে সেঞ্চুরি মেরে দিয়ে বসে থাকায় তার চেহারায় সব কিছুই কুৎসিত। রাস্তায় হাটতে গেলে এই বিভীষিকাময় কায়ার জন্যে কটাক্ষের পাশাপাশি সমীহ ও পাওয়া যায় অনেক, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে ডান গালের কৃত্তিম টোলটি বাদ দিয়ে প্রায় সবই তার অপছন্দ।
কৃত্তিম টোল সৃষ্টির গল্প ও বেশ মজার। খুব ছোট থাকতে মারামারি করতে গিয়ে গালে ব্যটের বাড়ি পরেছিল তার। এক মাসের বেশি সময় ধরে থাকবার পর গাল ফোলা যখন নেমে যায়, পেছনে রেখে যায় ছোট্ট একটি গর্ত। যাকে কিউট করে মানুষ বলে ডিমপল, কিন্তু আয়নায় ভুপেন আজো কিউট কিছু খুজে পেল না।
আজকে তার আফ্রোদিতির সঙ্গে দেখা করবার কথা। লকডাউনের প্রায় পাচ মাসে ফেসটাইম ছাড়া আর দেখা সাক্ষাত নেই, সেজন্যে গত কয়েকদিন ধরে তোড়জোড়ের সাথে বেশ করে প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছে ভূপেন। হাজার তিনেক দিয়ে পাঞ্জাবি কিনে মানিব্যাগে এখন খালি শ টাকার দুটো নোট বাকি। তাই গতকাল গভীর রাতে ফেরার সময় ভ্যানওয়ালা মামার কাছ থেকে আট আনার মায়া বিড়ি ধার করে খেতে হয়েছে। তবে ইচ্ছে আছে, মামার সাথে সুদিনে দেখা হলে এক প্যাকেট বেনসন ও নাহয় কিনে দেয়া যাবে।
বাকি দুশ টাকার হিসেব ও খুব জটিল। পঞ্চাশ টাকায় চুল কাটা আর ফোনের ত্রিশ টাকা বাদ দিলে আগামি দুদিনে মেজর কোন খরচ নেই। দিতি খাবার রান্না করে নিয়ে আসবে আর ক্যাম্পাসে কোন রিকশাও চলে না, সো খাবার আর ভাড়ার কোন ঝামেলা নেই। শুধু বন্যায় রাস্তার যেটুক ডুবে গেল, সেটুকু পারাপারে এক্সট্রা বিশ টাকা। একশ টাকার নোট একটা হলেও বেচে যাবে।
এসব আকাশ কুসুম চিন্তা করতে করতেই সেলুনের ভেতর থেকে কে যেন পানের টক্টকে লাল পিচকিরি মেরে দিল গায়ে। এসেছিল সেলুনে চুলের একটা গতি করতে, হয়ে গেল আরেকটা।
চাচা, এত জায়গা থাকতে মানুষের গায়ে কেন থুতু ফেলতে যান?
মধ্যবয়ষ্ক ব্যাক্তি, মাথায় পাকা চুলের সংখ্যা বেশি কিন্তু ঘটে বুদ্ধি আক্ষরিক ভাবেই মনে হয় কম। ভুল করলে মানুষ সাধারনত চোখ নামিয়ে নেয়, কিন্তু এ লোক সটান চোখের দিকে তাকিয়ে হেসেই যাচ্ছে। ভুপেনের ইচ্ছে ছিল চুল কাটিয়ে সাদা পাঞ্জাবি পরে সেলুনে দ্বিতিয়বারের মত ট্রায়াল দিয়ে দেখবে একটু নিজেকে। সে আশায় গুড়ে বালি না হয়ে পাঞ্জাবিতে পানের পিক হয়ে গেল।
না খেয়াল কইরে সারা পারি নাই! চোখে কম দেখিতো, কিছু মনে কইরেন না
এই বলে খুব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে এদিক সেদিক তাকাতে শুরু করলেন তিনি
আক্ষেপের দৃষ্টিতে একবার নিচে পাঞ্জাবিতে লেগে থাকা পিকের দিকে তাকিয়ে বাসার দিকে হাটা দিল ভুপেন। বিধাতা যেহেতু চাচ্ছে গ্রামীন চেক পরেই তাকে প্রেম করতে যেতে হবে, তবে তাই হোক। আর চাচাও বেশ বয়স্ক, বাবার বয়সি। কিছু বললে নিজের কাছেই খারাপ লাগবে।
আজকের সন্ধ্যের আকাশটা বেশ অদ্ভত। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং করে পড়ন্ত আলোয় আকাশে ভ্রমনরত মেঘের রং প্রায় পুরোটাই লালচে গোলাপি। দক্ষিন থেকে উত্তরে ভেসে যাচ্ছে আপনমনে। কয়েকটা দেখতে খরগোশের মত, কয়েকটা আবার গাংচিল। তবে ভুপেনের মনে আর শান্তি নেই। যার জন্যে তীর্থের কাকের মত এত অপেক্ষা, সে আর আসে নি। মুঠোফোনে পাচ লাইনের ছোট্ট একটি বার্তা আর ভুপেনের তিনটি বছর বাতাসে মিলে গেল।
আজকাল প্রেমচ্ছেদ মনে হয় প্রেম করবার থেকেও কঠিন। আগের জামানায় চিরকুট, সাত দিন লাগিয়ে চিটির আদানপ্রদান বা খরুচে টেলিগ্রাফ প্রেমের সাথে রোমাঞ্চক আরো অনেক কিছু জুড়ে দিত। কিন্তু, ইদানীং সবকিছুই কেমন যেন হিলিয়াম বেলুন ফুটে যাবার মত তাৎক্ষণিক।
জানবিবির চারুকলা ভবনের এ পাশ বেশ নির্জন। ঝিঝি আর বাতাসের শব্দ ছাড়া কিছু নেই এখানে। নেই কোন শহুরে বাহুল্যতা। সব কিছু খান খান করে ইনফেমাস ফকির ভায়ের গলায় ভিক্ষু সাধুর গান বেজে উঠলো। তামাকুর নেশায় বুদ হিজল গাছের ঠিক অপরপাশেই বশে থাকা ভাই খালি গলায় গেয়ে যাচ্ছেন, যেন বিশ্বের কারিগর ভুপেনের কষ্ট লাঘবের প্রচেষ্টায় চারপাশের পরিবেশে পরিবর্তন আনবার চেস্টা করে যাচ্ছে অনবরত।
ভাব আছে যার গায়ে, দেখলে তারে চেনা যায়
সর্ব অঙ্গ তাহার পোড়া রে,
ভবের ই ঘরে, আলেক শহরে,
আল্লা রাসুল বিরাজ করে রে।
হয়ত ভিক্ষু সাধু ও প্রেমে ব্যার্থ হয়ে দুনিয়াবি সকল কিছু বাদ দিয়ে জীবন সাধনায় নেমে এ গান লিখেছেন, হয়ত না। ভূপেনের জানবার উপায় নাই। তার জীবনদর্শন যে এখনো অপূর্ণ।