গত ডিসেম্বরের কথা। ঠান্ডার দিন শেষ হয়ে যাবে যাবে করে এমন সময়ে একদিন মনে আসলো যে, এই পুরো শীতে একদিনও খেজুরের রস খাওয়া হয় নাই। আগের শীতে কয়েক বন্ধু মিলে রসের সন্ধানে প্রায় প্রত্যেকদিন মাইলকে মাইল ঘু্রে ঘুরে খুজতাম। আশেপাশে তেমন একটা পাওয়া যায় না এখন আর, যার জন্যে এত ঘোরাঘুরি। খেজুরের রস শহুরে এলাকায় বেশি একটা আসে না আর তেমন। আরবান এলাকায় থাকা আমার দেশের মানুষদের নাক ইদানিং অনেক উচু হয়ে গেছে। এনারা নামি দামি শৌখিন মিষ্টান্ন বেশি পছন্দ করেন, রসের, গুঁড়ের মিষ্টি তাদের এখন মুখে রুচে না। যার কারনে কাধে করে কলসিতে নিয়ে রস বেচাও শহরে এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
তো যে কথায় ছিলাম, সেই বন্ধুরা সবাই তখন জীবন নিয়ে ব্যাস্ত। মানে নিদ্রাদেবীর সাথে গভীর প্রেমে নিমগ্ন তারা আরকি। কারোর আর আমার সাথে রস খুজতে যাবার আগ্রহ নাই। আট দশটা নাম্বার এ ডায়াল করলাম কেউ ধরলোই না শালারা। কাউকে না পেয়ে আবেগে, সৃতিবেদনায় আমার মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে গেল ভালোরকমের। রেগে মেগে জুতা পায়ে দিয়ে একাই বের হয়ে গেলাম রসের খোজে। বাইরে তখনো আলো ফুটে উঠবে উঠবে করেও উঠে না। সুবহে সাদিকের সময়ের যাযাবর মেঘেরা পুব থেকে দখিনের দিকে যায়, আমিও আমার বাইকে উঠে দাওয়াত ছাড়াই তাদের সাথ নিয়ে নিলাম।
গন্তব্য মনোদিয়া নামে কয়েক মাইল দুরের এক গ্রাম। আজগুবি নামের এই জায়গাকে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল বলা যায় না। রাস্তাঘাট একদম ঢালাই করে পাকা করা। স্থানীয়রা সব ধনী কৃষক, সবাই অনেক অনেক জমির মালিক, টাকা বেশি তাই উন্নতি বেশি। মাঝখানে উঠান সহ টিনের বাসাবাড়ী অনেক, দেখলে বনেদি একটা ভাব আসে।
কুয়াশায় ভিজিবিলিটি ফিট বিশেকের মত কিন্তু তার মাঝখান দিয়েই এই এলাকার রাস্তায় বাইকের গতি আশি নব্বই রেখে উড়ে উড়ে যাচ্ছি। বন্ধুদের উপরের রাগ বেচারা বাইক এর ওপর দিয়ে তোলার চেষ্টা আমার, তাই ঠান্ডার গোষ্ঠী উদ্ধার করে গালাগাল করতে করতে টেনে যাচ্ছি সমানে। রাস্তা ভালো দেখে এই এত গতি রেখে চালাইতে গিয়েই প্রায় ফেটাল একটা ভুল হয়ে গেল। প্রায় ফেটাল কারণ মরি নাই, অক্ষত ভাবেই ফেরত এসেই এই যে লিখতেসি। কিন্তু ভালো একটা শিক্ষা হয়ে গেছে ওইদিন।
এলাকার রাস্তা নতুন করে বানানো। উপরে গুড়ি গুড়ি পাথরের কার্পেটিং দেয়া, যার কারনে রাস্তা প্রায় মসৃণ সাথে কুয়াশায় ভিজে বাচ্চাদের স্লিপারের মতন পিচ্ছিল। মনোদিয়া বাজারে ঢুকবার ঠিক আগে একটা মোড় পরে যেখানে রাস্তার ব্যাঙ্কিং নাই বললেই চলে। গ্রামাঞ্চলের রাস্তা হাইস্পিড থ্রিলের জন্যে বানানো না, এই রাস্তায় বিশ এর উপর গতি তোলা বোকামি, যে তোলে, তার মাথায় ব্যারাম আছে। আমার মাথায় ব্যারাম আছে। সেই মোড়ে এসে গতি তেমন না কমায়ে ঘুরে গেলাম।
৫-৭ মিনিট, বেশি হলে দশ মিনিট চালানো হয়েছে ততক্ষনে। উচ্চ গতিতে হয় কি, যদি চাক্কা পর্যাপ্ত গরম না হয়, চাক্কার গ্রিপ নরম হয় না, আর নরম না হলে ব্রেকিংও ভালো হয় না। সাথে করে কুয়াশায় ভিজিবিলিটি কম।
তো বাইক কাত করে মোড় ঘুরে যে গতি বাড়াবো আবার, সামনে রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে কে যেন হেটে হেটে আসে। ডানে চাষের সরিষার ক্ষেত, বামে ইন্ড্রাসট্রিয়াল বর্জ্য দিয়ে টইটম্বুর করে ভরা খাল। আর সামনের লোকটাও আমাকে দেখে ভয় পেয়ে খাম্বার মতন দড়িয়ে গেলেন। বামে রাস্তা নাই, ডানে রাস্তা নাই, করণীয় একমাত্র বাকি হল শক্ত করে লাগাম চেপে ধরা। করলাম ও তাই, ধরলাম লাগাম টেনে খিচে, কাজ হলো না। আল্লাহর নিরানব্বই নাম ধরে ডেকে ফেললেও সময় মত গতি কমার কোন সুযোগ নাই। লোকটা আমার হেলমেটে হাত দেওয়ার পরে টের পাই যে আমি রাস্তার পাশে দেবদাসের মত বসে আছি। সামনে ক্ষেতে বাইকের ফেয়ারিং নদী থেকে টেনে তোলা কাতল মাছের পেটের মত আকাশের দিকে উঠে আছে, আর চাক্কা সমানে ঘুরেই যাচ্ছে তো ঘুরেই যাচ্ছে।
হালকা পোস্ট দুর্ঘটনার ট্রমা ছাড়া বিধাতার কৃপায় সম্পুর্ন অক্ষত ভাবে উঠে আসি। হাতের গ্লাভসে ছেড়া আর বাইকে নুন্যতম দাগ ছাড়া কিছু হল না। কিন্তু আমার একটা চমৎকার শিক্ষা হয়ে গেল। এটাই যে, পায়ের নিচে লোহা গরম হোক বা না হোক, রস আর কামের ফাঁদে পরা যাবে না।