মিথানল
মিথানল, যা মিথাইল এলকোহল, উড এলকোহল, উড ন্যাপথা, উড স্পিরিট ইত্যাদি নামে পরিচিত, একটি রাসায়নিক পদার্থ। যার আণবিক সংকেত, CH3OH । রসায়ন শাস্ত্রে সংক্ষেপে লেখা হয় MeOH। ইংরেজীতে এটাকে উড এলকোহল বলা হয় কারণ একসময়ে কাঠের বিধ্বংসী পাতনের দ্বারা এলকোহল প্রস্তুত করা হত। আধুনিক মিথানল সরাসরি কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং হাইড্রোজেন থেকে ক্যাটালাইটিক শিল্প পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হয়। অ্যালকোহলের প্রকারভেদের মধ্যে মিথানল সব থেকে সরল অ্যালকোহল। এটা হালকা, উদ্বায়ী, দহনশীল , বর্ণহীন তরল।[৫] ইথানলের মত গন্ধ থাকলেও মিথানল পানযোগ্য নয়। এটি খুবই বিষাক্ত এবং হজমের অনুপযোগী। কক্ষতাপমাত্রায় এটি পোলার দ্রাবক হিসেবে কাজ করে। এন্টিফ্রিজ, দ্রাবক, জ্বালানী হিসেবে মিথানল ব্যবহার করা হয়। শিল্প কারখারখানার জন্য আমদানীকৃত ইথানল পানের অনুপযোগী করতে এর সাথে মিথানল মিশ্রিত করা হয়।
source
প্রকৃতিতে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ায় এনারোবিক মেটাবোলিজমের মাধ্যমে মিথানল উৎপন্ন হয়। এর ফলে পরিবেশে সামান্য পরিমানে মিথানল বা মিথানলের বাষ্প উপস্থিত থাকে। কয়েকদিনের মধ্যে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে বায়ুমন্ডলীয় ইথানল জারিত হয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড ও পানি তৈরী করে।
মিথানল বাতাসের উপস্তিতিতে অক্সিজেনে পুড়ে কার্বন ডাই অক্সাইড ও জল উৎপন্ন করে:
2 CH3OH + 3 O2 → 2 CO2 + 4 H2O
অধিক পরিমানে মিথানলের উপস্থিতি ফরমিক এসিড বা ফরমেট লবনের মেটাবোলাইজ ঘটায় যা কেন্দ্রীয় স্নায়ু তন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর্। এর ফলে অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ব এমন কি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শিল্প কারখানার জন্য আমদানিকৃত মিথানল মিশ্রিত ইথানলকে বলা হয় মিথাইলেটেড স্পিরিট। বাংলাদেশে প্রতিবছর অনেক মানুষ এই বিষাক্ত স্পিরিট পানের কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
মিথানলের ইতিহাস
প্রাচীন মিশরে মিশরীয়গণ মিথানল ব্যবহার করত। তারা কাঠের পাইরোলাইসিস থেকে মিথানল প্রস্তুত করার পদ্ধতি জানতো। ১৬৬১ সালে রবার্ট বয়েল বক্সাস (বক্সউড) এর পাতনের মাধ্যমে মিথানল প্রস্তুতের সময় প্রথম বিশুদ্ধ মিথানল তৈরী করেন।[৬] এই বিশুদ্ধ মিথানল পরে পাইরোজাইলিক স্পিরিট নামে পরিচিত পায়। ১৮৩৪ সালে ফরাসি রসায়নবিদ জ্যঁ বাপতিস্তে দ্যুমা এবং ইউজিন পেলিগট এটার উপাদানগত অনুপাত নির্ণয় করতে সক্ষম হন।[৭] তারাই প্রথম জৈব রসায়নে মিথিলিন শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করে। গ্রীক ভাষায় মিথাইল মানে ওয়াইন বা মদ এবং হাইল মানে কাঠ। ১৮৪০ সালে এটাকে মিথাইল অ্যালকোহল নামে ডাকা হতো। ১৮৯২ সালে রাসায়নিক নামকরণের আন্তঃর্জাতিক সংস্থা IUPAC এটার নামকরণ করে মিথানল।[৮] জৈব রসায়নে পূর্বপদ মিথাইল দ্বারা কাঠ থেকে আহরিত কার্বনের একটি সমগোত্রীয় শ্রেণীর নামকরণ করা হয়েছে। ১৯২৩ সালে জার্মান রসায়নবিদ আলউইন মিত্তেশ এবং ম্যাথিয়াস পিয়ার BASF এর জন্য কাজ করার সময়ে সংশ্লেষিত গ্যাস (কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং হাইড্রোজেনের মিশ্রণ) কে মিথানলে রুপান্তরিত করার উন্নত পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য গবেষণা চালান। ১৯২৬ সালের ১২ জানুয়ারি তারা তাদের আবিষ্কৃত পদ্ধতির প্যাটেন্ট নেন। রেফারেন্স নঃ ১,৫৬৯,৭৭৫ ।
উৎপাদন সংশ্লেষিত গ্যাস
প্রভাবকের উপস্থিতিতে কার্বন মনোক্সাইড এবং হাইড্রোজেন বিক্রিয়া করে মিথানল উৎপন্ন করে।
বর্তমানে কপার, জিংক অক্সাইড এবং এলুমিনার মিশ্রণ প্রভাবক হিসেবে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৬ সালে ইমপেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিস প্রথম এই প্রভাবক মিশ্রণ ব্যবহার করে। 5–10 MPa (50–100 atm) চাপে এবং 250 °C তাপমাত্রায় এটা কার্বন মনোক্সাইড এবং হাইড্রোজেন থেকে মিথানল উৎপাদনকে প্রভাবিত করে:
CO + 2 H2 → CH3OH
মিথেন থেকে সংশ্লেষন গ্যাস উৎপাদনের সময় এক মোল কার্বন মনোক্সাইডের জন্য তিন মোল হাইড্রোজেন উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে মিথানল প্রস্তুতিতে এক মোল কার্বন মনোক্সাইডের জন্য দুই মোল হাইড্রোজেন ব্যবহৃত হয়। অতিরিক্ত হাইড্রোজেন কার্বন মনোক্সাইডের সাথে যুক্ত হয়ে মিথানল তৈরী করে।
CO2 + 3 H2 → CH3OH + H2O
অনেক রসায়নবিদের মতে কিছু প্রভাবক CO2 কে অনর্মধ্যক (ইন্টারমিডিয়ারি) হিসেবে ব্যবহার করে এবং পরোক্ষভাবে CO গ্রহণ করে মিথানল সংশ্লেষন করে।
CO2 + 3 H2 → CH3OH + H2O
এখানে H2O উপজাত পানি গ্যাস স্থানান্তর বিক্রিয়ার মাধ্যমে রিসাইকেল করা হয়।
CO + H2O → CO2 + H2,
পুরো বিক্রিয়াকে একত্রে লেখা যায়:
CO + 2 H2 → CH3OH
মিথেন থেকে
কপার জিয়োলাইট এবং অন্যান্য প্রভাবক ব্যবহার করে সরাসরি প্রভাবকীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে মিথেন থেকে পর্যাপ্ত মিথানল প্রস্তুত হয় । [৯]
কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে
source
কার্বন ডাই অক্সাইডে ডোবানো কিউপ্রাস অক্সাইডে মোড়ানো কপার অক্সাইড দন্ড এবং সূর্যালোকের শক্তি ব্যবহার করে সরাসরি মিথানল প্রস্তুত করা যায়।[১০]
মেথিলেটেড স্পিরিট
মদ, বিয়ার, হুইস্কি, ব্রান্ডি প্রভৃতি পানীয় ইথাইল এলকোহল হতে প্রস্তুত করা হয়। এ পানীয়সমহূল প্রকৃতপক্ষে ইথাইল এলকোহলের বিভিন্ন ঘনমাত্রার জলীয় দ্রবণ বিশেষ। এসকল পানীয়ের উপর প্রচুর আবগারী শুল্ক দিতে হয়। তাই এগুলো অত্যন্ত মহার্ঘ। অনেক সময় মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা বাজার হতে সস্তা দামের ইথাইল এলকোহল কিনে এর সঙ্গে প্রয়োজন মত পানি মিশ্রিত করে দামী বাণিজ্যিক মদের বিকল্প হিসেবে পান করে। পানের কাজে এরূপ যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে ইথাইল এলকোহলের ঘাটতি পড়তে পারে। কারণ দ্রাবক এবং শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদনকাজে ইথাইল এলকোহল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তাই পানীয় হিসেবে ইথাইলে এলকোহলের অনঅনুমোদিত ব্যবহার বন্ধে এর সাথে মিথানল, পিরিডিন, ন্যাপথা প্রভৃতি বিষাক্ত পদার্থ মিশিয়ে বাজারজাত করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে এরূপ অ্যালকোহলকে মেথিলেটেড স্পিরিট, ডি ন্যাচারড অ্যালকোহল বা অসেবনীয় অ্যালকোহল নামে পরিচিত। এটি বিশেষভাবে রং-বার্ণিশের কাজে দ্রাবক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।[১১] মেথিলেটেড স্পিরিটকে ইথানলের প্রকারভেদ হিসেবে গন্য করা হয়।
মিথানল সমস্যা
মিথানল বেশ কিছু সমস্যার জন্য দায়ী।
মানবদেহে মিথানলের স্বাস্থ্যঝুঁকি
মিথানল স্নায়ুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর এবং এর অত্যধিক উপস্থিতির কারণে অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ব, মৃত্যু হতে পারে। তবে মিথানলের খুব সামান্য উপস্থিতি মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে ৪.৫ ppm পর্যন্ত মিথানল গ্রহনযোগ্য ।[১২] এক পিপিএম বলতে বোঝায় দশলক্ষ ভাগের এক ভাগ। গবেষণার তথ্য থেকে বোঝা যায় একজন মানুষ প্রতিদিন ফলের পেকটিন থেকে প্রাপ্ত ০.৪৫ গ্রাম মিথানল হজম করতে পারে। ১কেজি আপেল থেকে সর্বোচ্চ ১.৪ গ্রাম মিথানল পাওয়া যাবে।[১৩]
জমাট পাতন
source
"'এপলজ্যাক"' নামক পানীয়তে জমাট পাতন পদ্ধতিতে মিথানল জমাট বাঁধে। যা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এই কারণে অনেক দেশে এপলজ্যাক নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিষাক্ততা
মানুষের শরীরের পক্ষে মিথানল খুবই বিষাক্ত। একজন মানুষের শরীরে যদি ১০মিলি বিশুদ্ধ মিথানল প্রবেশ করানো হয় তবে এটা ভেঙে ফরমিক এসিডে পরিণত হয় যা অপটিক নার্ভকে ক্ষতিগ্রস্থ করে পুরোপুরি অন্ধ করে ফেলে।[১৪][১৫]) মিথানলের রেফারেন্স ডোজ হচ্ছে ০.৫ mg/দিন।[১৬] বিষক্রিয়া শুরু হতে ঘন্টা খানেক সময় নেয় এবং এর মাঝে ইফেকটিভ এন্টিডোটস কাজ শুরু করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এন্টিডোটস স্থায়ী ক্ষতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। [১৪]
বেভারেজ এলকোহল ইথানলের মত দেখতে ও গন্ধ হওয়ায় মিথানলকে অধিকাংশ সময় আলাদা করা যায় না। আর মিথাইলেটেড স্পিরিটকে তো ইথানল বা মদ ভেবে ভূল করে। ১৯৩০ এর দিকে মাইক ম্যালয় নামে এক ব্যক্তিকে মিথানল প্রয়োগে হত্যা করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। [১৭]
গুণগত বৈশিষ্ট্য এবং বিশ্লেষন
গবেষণাগারে ব্যবহারের জন্য মিথানল
বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন গ্রেডের মিথানল পাওয়া যায়।
বাণিজ্যিক মিথানল
সাধারণত ASTM purity grades A এবং AA অনুসারে বাণিজ্যিক মিথানলকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। জাহাজ , ট্যাংকারে করে যখন মিথানল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয় তখন বিভিন্ন বস্তু দ্বারা অবিশুদ্ধ হতে পারে। তাই যানবাহন এবং কার্গো খুব ভালো ভাবে পরীক্ষা করা উচিত।
শক্তি বাহক
মিথানল শক্তিবাহক হিসেবে যথেষ্ট উপকারী। এটা হাইড্রোজেনের তুলনায় খুব সহজে সংরক্ষন করা যায়। মিথানল জীবাশ্ম জ্বালানীর চেয়ে ভালো জ্বলে।
গাড়ীর জ্বালানী