সকাল তো প্রতিদিনেই হয়। প্রতিদিনের সকালে কোন না কোন ন্যাঠা লেগেই থাকে। কালকের সকালটা তো শুরু হয়েছিল কাউয়া-ক্যাচাল দিয়ে। রাতটা শেষ হয়েছে হুইহুল্লোর গান বাজনা আর লোকজনের গোমগোমানি শব্দে। বাড়ির পাশেই এক ছোট মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল। সবেই তো মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। সে জন্যই এতো গান বাজনা শব্দ চিৎকার চেচামেচি। এর মাঝে কি আর ঘুম হয়। তাই রাতের ঘুমটা কেমন হয়েছে তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।
ছোট ছোট পিচ্চি মেয়ে গুলোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর তপনরা পরে আছে এখনো। সে বিরবির করছিল - "তপন, বিয়ে টা সেরে ফেল। বয়স তো আর কম হল না।" এই কথা ভাবতে ভাবতে রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমিয়েছিল। তাই কি আর করার, সকালটাও হয়ে গেলো দেরি। মানে ঘুম থেকে উঠেই দেখে ঘড়ির কাটা অনেক দূর এগিয়েছে।
ধর পরিয়ে উঠে নিজে নিজেকেই বলতে লাগলো -"না রে তপন, এভাবে আর চলে না, তুই আর কোন কাজের হইলি না। আর কত দিন এভাবে থাকবি। দায়িত্ব বলে কিছু আছে। সেটা কাঁধে তুলে নে। না, তোর দাঁড়ায় সংসার চলবে না।" আজকাল নিজের সাথে নিজেই একটু বেশিই কথা বলা হচ্ছে তপনের। আপনারা হয়তো ভাবছেনও তপনের মাথাটা অকালেই হয়তো শেষ হয়ে গেলো।
তপন বিয়ে সাদি আর ভবিষ্যত নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছে। ২৭ গড়িয়ে ২৮ শেষের দিকে। এই তো আগামী ১৫ আগস্টে ২৯ এ পা দিবে। এই দিনটিতে আবার সে তার জন্মদিনও পালন করতে পারে না।
তপনের পরিবারে মা আর বোন। বাবা সরকারী চাকুরি করতেন অবসর গ্রহণের পর গত বছরেই চিরস্থায়ী জীবনের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। বাবার পেনশনটা মা পায়। যা পেনশন পায় তা দিয়েই সংসার চলে না। গ্রাজুয়েশন শেষ করেও কোন চাকরী পাওয়া যাচ্ছে না। মামু ছাড়া এই স্বাধীন দেশে চাকরী হয় না। বাবার অবসরে গেলে কিছু টাকা পায় তা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করা আছে। চাইলেই ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে পারে। কিন্তু তপন নীতিবান। নিজের নীতির সাথে বিন্দুমাত্র আপোস করতে রাজী নয়।
তপনের দূর আত্মীয়ের একজন ওষুধের দোকান করে। শহরে বেশ বড় সর দোকান। ভালোই উন্নতি করেছে ওষুধ বিক্রি করে। তপনের চোখ সেখানেই। ওষুধ ব্যাবস্যায়ে নাকি ভালো লাভ। এদিকে তপনের পরিবারের ব্যায় চালানো কঠিন। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল সেই আত্মীয়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে থাকবে। এতে তার দুটা লাভ হবে। এক তার অভাবটাও মিটবে আবার তার ওষুধের ব্যবস্যার লাইন ঘাট জানা হবে। চাকরী তো হচ্ছে না কিছু তো একটা করে খেতেই হবে। পরিকল্পনা খারাপ না। সে কথা পাকা করে ফেলেছে কাল থেকেই কর্মচারী হিসেবে যোগ দিবে।
গ্রাজুয়েশন শেষ করে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে কাজে যোগ দেয় তপন। পাড়া প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজনের কটু কথায় পাত্তা না দিয়েই নিজের মত কাজ করেই যাচ্ছে। নতুন নতুন কাজ শুরু করেছে। হরেক রকমের মানুষের আনাগোনা। প্রতিনিয়তই শিখছে।
সবে মাত্র তিনদিন হলো। হঠাৎ এক যুবক তপনের সম বয়সি হবে। হয়তো নতুন বিয়ে করেছে।
-ভাই ইয়ে দেন তো। তপনের পিছনে ডনলেস, সেনসেশন ডটেড এর ঝুলিয়ে থাকা প্যাকেট ইশারা করিয়ে।
-ইয়ে আবার কি? কি লাগবে বলেন ভালো করে।
-আবার পিছনে ইশারা করে ভাই ইয়ে দেন।
-তপন কর্কশ শব্দে ধুর ভাই প্রেসক্রিপশন দেন।
কাস্টোমার চোখ গুলো বড় বড় করে তপনের দিকে তাকিয়ে চলেই গেল। মালিক মহোদয় নিজের চেয়ারে বসে দুজনের তামাশা দেখছে আর মিট মিট করে হাসছে আবার হালকা রাগ ও হচ্ছে।
আবার একদিন এক মুরুব্বির আগমন বয়স এই পঞ্চাশের কাছাকাছি।
-ভাই ইয়ে দেন তো। পিছনে ইশারা করে।
-তপন অনেক গুলো বার করে বলে কোনটা লাগবে?
-মুরুব্বি বামে ডানে তাকিয়ে যে কোন একটা দ্রুততার সাথে পকেটে ঢুকিয়ে দাম কত?
-আরে ভাই পকেটে ঢুকাচ্ছেন কেন?
-ভাই, দাম কত?
-এতো টাকা।
মনে মনে তপন শালার বুড়ার জাওয়ানী এখনো যায় না।
তপনকে তার মালিক ইতিমধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছিল ইয়ে বলতে ইয়ে। কিন্তু এটা বুঝায় নিই যে প্রকাশ্যে কাস্টোমারের সাথে এগুলো ডিল করা যাবে না। একটু ভিন্ন আঙ্গিকে করতে হবে। এভাবেই দেখতে দেখতে তপনের দুটা বছর হয়ে গেলো।
কিছু টাকা পয়শাও জমিয়েছে তপন। ওষুধ ব্যবস্যার নাট ঘাট ও বুঝে গিয়েছে। অভিজ্ঞতা তো কম হল না। এখন নিজের ব্যবস্যা শুরু করবে।
ইতি মধ্যে সে আবার ইতির সাথে রিলেশনেও জড়িয়ে পরেছে। সুন্দর মায়াবী চেহারা। মাঝে মধ্যেই দোকানে আসতো। মালিককে নিজের বড় ভাইয়ের মত মনে করতো। মালিক ও তার সহজ সরল মানসিকতা ও নীতিবান থাকায় খুব পছন্দ করতো। ইতির ব্যাপারটা সে মালিককে জানিয়েছিল।
যাই হোক নিজের ব্যবস্যা শুরু করেই ইতির সাথে বিয়েটা সেরে ফেলবে। মেইন বাজারে অনেক কষ্টের পর ভাড়ায় দোকান নিয়েছে তপন। ইতির কিছু জমানো টাকা ছিল তাও তপনকে এনে দিয়েছে যাতে সে ব্যবসা শুরু করতে পারে। মা আর ছোট বোন ও অনেক খুশি। দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন বাস্তব হতে চলেছে। সব কিছুই ঠিক ঠাক ভাবেই এগুচ্ছে। পরশু থেকেই দোকান উদ্বোধন করবে।
তপন শুয়ে রেস্ট নিতেই ইতির ফোন
-কি করছো বাবু, সিএসডি মোড়ে আসো আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।
-ওকে আসছি, দুটা মিনিট।
তপন তাড়াহুড়ো করে সাদা পাঞ্জাবী আর গায়ে একটি কালো চাদর পরে বেরিয়ে পরলো। পথি মধ্যে জ্যামে পরে একটু দেরি হয়ে গেলো। ইতি দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তপন রিক্সা থেকে নেমেই দু পা আগাতেই পিছন থেকে একটা ট্রাক ধাক্কা মেরে চলে যায়। সাদা পাঞ্জাবী রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। ইতি দৌড়ে এসে হাউ মাও করে কান্না কাটি শুরু । আসে পাশে সবাই দ্রুত নিয়ে যায় রংপুর মেডিক্যালে জরুরী বিভাগ থেকে। ইতি চোখে শুধু তপনের রক্তাক্ত দেহ।
ইতি তপনের মা কে ফোন লাগিয়ে মা মা বলতেই জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলে।