আস্সালামুআলাইকুম, বাংলাদেশী স্টেমিয়ানরা, আপনারা সবাই কেমন আছেন ? আজকে আপনাদের সাথে ১টি সত্যিকার অনুপ্রেরণামূলক গল্প শেয়ার করব।
বাংলাদেশে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন হয় না। তাই প্রতি বছর বহু মেধাবী ছেলে মেয়ে দেশ পাড়ি দিয়ে বিদেশ চলে যায়। আর যারা দেশে থাকে অথবা বিদেশ থেকে দেশে আসে তাদের কতটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সে গল্পই আজকে শেয়ার করলাম। উচ্চ শিক্ষিত, মেধাবী Mohammad Sorowar Hossain বিদেশ থেকে দেশে এসে কত প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন ? জানতে হলে গল্পটি পড়ে দেখুন।
আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে প্রচন্ড গরমের দিনে বিমানবন্দরে অবতরন করি। সিঙ্গাপুর থেকে প্রতি বছরই দেশে বেড়াতে আসার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এবারের অবতরনে দীর্ঘ ১০+ বছর পর অন্য এক বাংলাদেশকে আবিষ্কার করা শুরু করি। সবাই কেন জানি ভুল বোঝা শুরু করল। মানসিক সাপোর্টের পরিবর্তে মস্করা, টিপ্পনী কাটত যা শুনে খুব কষ্ট লাগত। পারিবারিকভাবে বৈষয়িক না হওয়ার কারনে ফেরার সময় তেমন সম্বল ছিল না। মাত্র লাখ দুয়েক টাকা যা দিয়ে ফার্নিচার কিনি। ফাতিমার স্কুলে পড়াও অনিশ্চিত হয়ে গেল। শুধুমাত্র ট্রান্সপোর্টের অভাবে ভাল স্কুলে সুযোগ পেয়েও কন্টিনিউ করতে পারল না। খেলারও জায়গা নেই। প্রতিমাসেই জ্বরে ভোগা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। ও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শুধু চোখের জল ফেলত। বাবা হিসেবে যা মেনে নেয়া অত্যন্ত কষ্টের।
শুরুতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট-টাইম শিক্ষকতা করি। চার মাস পর তিনটি জবের অফার আসে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেণ্টার ফর এক্সিলেন্সে, আইসিডিডিআরবি এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। চিন্তা-ভাবনা করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করি। দেশে পা দিয়েই রিসার্চে নেমে পড়ি। কাউকে চিনি না। গুগুল সার্চ করে পার্সোনালি যোগাযোগ করতে চেষ্টা করি। বিভিন্ন রিসার্চ প্লাটফর্মে ইমেল করি রিসার্চ কলাবোরেশনের উদ্দেশ্যে। অবশেষে বারডেমের ড তানভীরা আপার সাথে পরিচয় হলো। উনার কাছে যা ডাটা আছে তা নিয়েই রিসার্চ শুরু করলাম। আমরা দুজনে বিভিন্ন জায়াগায় গিয়েছি রিসার্চের স্কোপ বাড়াতে। অবশেষে আমাদের উদ্যোগের সাথে আরো ১০টি প্রতিষ্ঠান জড়িত হলো। ব্লাড ক্যান্সারের উপর ৫,০০০ কেইস এনালাইসিস করে BMC Cancer-এ আমাদের প্রথম পাবলিকেশন হলো ২০১৪ সালে। মাত্র দুবছরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এফিলিয়েশনে ৬টি পাবলিকেশন হয়। এর পরই সবকিছু ওলোট-পালট হয়ে গেল!
ক্লাসে, কলিগদের সাথে শুধু রিসার্চ নিয়ে আলাপ হতো, স্বপ্ন দেখতাম। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন কলিগ অফিস পলিটিক্স শুরু করে যা আমি ছেড়ে আসার পর ছাত্রদের কাছে জেনেছি। কিছু কিছু স্টুডেন্টদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করাতো! চলে আসার পর তাদের কেউ কেউ পারসোনালি ক্ষমা চেয়েছে। সিনিয়র টিচার পিয়নের মাধ্যমে তাদের রুমে ডাকলেই চিন্তায় মুখ শুকিয়ে যেত, জব স্থায়ী না করার থ্রেট, পাবলিকেশনের খুশীর খবরে এপ্রিসিয়েট করার পরিবর্তে হতো জুটত বকাঝকা। আমার বাবার বয়সী শিক্ষকরা কেন যে আমার সাথে এমন আচরন করতেন তা মাথায় ধরত না। আমি ছোট্টবেলা থেকেই দায়িত্ব সম্পর্কে খুব সিরিয়াস এবং সিনসিয়ার যা আমার অভ্যাসের অংশ। মনে-প্রাণে তাঁদের খুব শ্রদ্ধা করতাম। পরে বুঝেছি উনারা সিলেক্টিভ কিছু মানুষের শুনা কথায় এডমিনিস্ট্রেশন চালান! সেমিনার, সিম্ফোজিয়াম রিসার্চ কলাবোরেশনের জন্য যেন দৌরঝাপ না করতে পারি সেজন্য অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম ব্র্যাকে আর থাকব না।
মলিকিউলার ডায়াগোনিস্টিকের উপর একটি কোলাবোরেটিভ টিম বানাতে আমাদের প্রফেশনাল গ্রুপে ইমেল করি। এটি নিয়ে আমাকে ওপেন ফোরামে আমাকে ফকির বলে তাচ্ছিল্য করা হয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি টাকার জন্য পড়াই, আমি বাংলাদেশকে ছোট করেছি! আমার সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের ব্যবহারে মানসিকভাবে খুবই কষ্ট পেয়েছি। এরপর থেকে ডিপার্টমেন্টে যাওয়া মোটামুটি ছেড়ে দিয়েছি। খুব কষ্ট হয়েছে তারপরও সেই শিক্ষককে মানসিকভাবে আল্লাহর ওয়াস্তে ক্ষমা করে দিয়েছি। এর মাঝে এক অনাগত সন্তানকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার অবস্থায় নিপাতিত হলাম।
হঠাত করে ইনসেপ্টা আমার সাথে যোগাযোগ করে। ওদের বায়োটেক ডিভিশনে R&D এর দায়িত্ব নেয়ার জন্য অফার আসে। সেই প্লান্টের যিনি দায়িত্ব ছিলেন তিনি যে পজিশনের জন্য আমাকে রিকমেন্ড করেছেন তার চেয়ে দু’পজিশন উপরে আমাকে ওফার দেয় ইন্সেপ্টার মালিক নিজেই। আমাকে বলা হলো শুধুমাত্র রিসার্চ করতে। দু’পজিশনে উপরে জয়েন করার পরে আমার বস (সিনিয়র ভাই, এক পজিশন উপরে) শত্রু হয়ে গেলেন। ইন্ডাস্ট্রির বাইরের মানুষদের কাছে এসব কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আমি যেন হতাশ হয়ে ইন্ড্রাস্ট্রি ছেড়ে যাই এজন্য আমাকে প্রায় একছর কোন কাজ ছাড়াই বসিয়ে রাখা হলো! টপ ম্যানেজমেন্ট সম্ভবত কিছুই জানতেন না যদিও তারা সবকিছু জানেন ভাব দেখান! এটিই বাংলাদেশের বাস্তবতা। তারপরও হাল ছেড়ে দেইনি। সারাদিন ভবিষ্যতের রিসার্চ আইডিয়া নিয়ে পড়াশুনা করতাম। আর চা পান করতাম! লেন্টুকে এখনো খুব মিস করি। সে বুঝত আমি কখন চা ফিল করি! জীবনের এই সময়ে সম্ভবত আমি সবচেয়ে বেশী পড়াশুনা করেছি। ইন্ড্রাস্ট্রি-ইউনিভার্সিটি রিসার্চ কলাবোরেশনের কালচার তৈরী করতে ইন্সেপ্টায় মূলত জয়েন করেছিলাম। হেকেপ প্রজেক্টের জন্য তিনটি প্রজেক্টে ইন্ড্রাস্ট্রির পক্ষ থেকে কো-অর্ডিনেট করেছিলাম। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় একটি এক মিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট আমরা পাই। কিন্তু শেষ মুহুর্তে সাইনিং এর আগে সেই প্রজেক্ট থেকে আমার নাম-ই বাদ দেয়া হয়! আমাকে বাদ দেয়ার প্ল্যান ছিল অনেক আগে থেকেই। হজ্জ থেকে ফিরে এসে খোজ নিয়ে জানতে পারি যে প্রজেক্ট জড়িত ছিলেন না তাকে নিয়ে বেশ কয়েকটি মিটিং হয়! এ ইস্যুতেই মূলত ইসেপ্টাতে আর থাকা হলো না। রিসার্চে প্যাশন হওয়ার কারনে আমার একটি পেপারে ইনসেপ্টার নামও রয়েছে! রিসার্চ কিন্তু থেমে থাকেনি।
অবশেষে ২০১৬ সালের শুরু থেকে ১০ মাস ফরমাল জব ছাড়া বাংলাদেশে কাটাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সময়টাইতে লং-টার্ম রিসার্চের জন্য একটি মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি প্লাটফর্ম বানানোর প্রচেষ্টা অনেকদূর এগিয়ে যায়। আল্লাহর ইচ্ছায় এই ক্রিটিক্যাল সময়ে একদল দেশপ্রেমিক ভাল মানুষের সহচর্য লাভ করেছি যা অনেকের ধারনার বাইরে। মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি কলাবোরেশনের মাধ্যমে রিসার্চ ফান্ড ছাড়াই যে বাংলাদেশে অনেক বড় কিছু করার সম্ভব সেই ধারনা আরো মজবুত হয়েছে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে আমরা তিনটি পেপার ভাল জার্নালে সাবমিট করেছি। কিছুদিনের মধ্যে থ্যালাসেমিয়ার উপর পেপারটি অনলাইনে আসছে। বাকী দুটো রিভিউতে গেছে। আরো ৪/৫টি ম্যানুস্ক্রিপ্ট তৈরী কাজ চলছে।
সারকথা হচ্ছে-বাংলাদেশ খুব চ্যালেঞ্জিং প্লেস। তবে একবার নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে অনেকে এগিয়ে আসেন। দেশে ফেরার পর গত পাঁচ বছরে ৭টি পেপার কট্রিবিউট করতে আল্লাহ তৌফিক দিয়েছেন, ২টি রিভিউতে আছে, আরো ৪/৫ আন্ডার প্রিপারেশনে রয়েছে। আল্লাহ জীবিত এবং সুস্থ রাখলে দেশের হেলথ সেক্টরে বড় ধরনের পজিটিভ কন্ট্রিবিউট করার স্বপ্ন দেখি। সবচেয়ে কাছের বন্ধু বাবাকে সেই ক্রিটিক্যাল সময়ে হারিয়ে অনেক কিছুর রিয়েলাইজেশন এসেছে। মানুষের সুস্বাস্থ্য এবং কল্যানে আত্ননিয়োগ করাই হচ্ছে আমার বাকী প্রফেশনাল জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।